ছফওয়ান আল মুসাইব

বন্ধুত্বের শেষ পাতা 

বন্ধুত্বের শেষ পাতা 

শৈশবে ছেলে-মেয়েরা চঞ্চল এবং একটু দুষ্ট প্রকৃতির হয়। আমিও তার ব্যতিক্রম ছিলাম না। তবে দুষ্টু হলেও পড়া-লেখা এবং খেলা-ধুলায় কখনো কারো থেকে পিছে পড়িনি। ছোটবেলা থেকেই ফুটবল খেলার প্রতি রয়েছে আমার অন্যরকম এক আকর্ষণ। যাকে ফুটবল প্রেমিক বললেও ভুল হবে না। ক্লাসের ফাঁকে সুযোগ পেলে’ই বল নিয়ে স্কুল মাঠে নেমে পড়তাম। এর জন্য যে আমাকে প্রিন্সিপাল স্যারের কাছে কত বকা এবং বেত খেতে হয়েছে, তার কোন হিশেব নেই। মাঝে মধ্যে তো ক্লাস বাদ দিয়েও খেলার জন্য মাঠে নেমে পড়তাম। যদিও পরের দিন প্রিন্সিপাল স্যার তার পুরো ক্লাসে আমাকে বেঞ্চের উপর কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখত। তাতেও আমার মধ্যে কোন পরিবর্তন ছিল না।

আমাদের প্রতিবেশী আন্টি। তার এক মেয়ে ছিল। নাম ইভা। আমরা একই ক্লাসে পড়তাম। ইভা আমার থেকে বয়সে কিছুটা বড় ছিল। যার কারণে আমি ইভার প্রতি সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা পোষণ করতাম। কিন্তু ইভা আমার সাথে যে ধরনের আচার-ব্যবহার করত, তাতে আমার কাছে মনে হতো যেন_ আমরা দু’জন দু’জনের ‘জাত শত্রু’। যা ইঁদুর বিড়ালের সম্পর্কের মত বলা চলে!

ইঁদুর যেমন বিড়ালের ভয়ে সব সময় তিন মাইল দূর দিয়ে চলে। আর যদি কখনো সামনা-সামনি সাক্ষাৎ হয়েও যায়, তাহলে ইঁদুর বিনয়ের সাথে সালাম দিয়ে কেটে পড়ার চেষ্টা করে। কিন্তু বিড়াল তার ধর্ম অনুযায়ী ইঁদুরকে লম্বা একটা দৌড়ানি দিয়ে সালামের জবাব দেওয়ার চেষ্টা করে। আমাদের বিষয়টাও ছিল ঠিক এমনই। এছাড়াও আমি বাসায় কী কী করি, আম্মুর কাছে কতবার বকা খাই, টিভিতে কার্টুনের কোন কোন চ্যানেল দেখি, স্কুলে গিয়ে এসব বিষয় আমার সহপাঠীদের কানে তুলে দেওয়া। আবার স্কুলে যাওয়া-আসার পথে অথবা স্কুলে কারো সাথে ঝগড়া বা খেলতে গিয়ে মারপিট করলে এমনকি প্রিন্সিপাল স্যারের কাছে কোন শাস্তি পেলে, সেগুলো বাসায় এসে পই পই করে আমার আম্মুর কাছে বলা_ এটা যেন ইভার নিত্যদিনের রুটিন ছিল। আর আমি নিষ্পাপ অবুঝ শিশুর মতো এসব নির্যাতন সহ্য করে যেতাম। কারণ আম্মুর কাছে ইভার করা সমস্ত অভিযোগ সত্য আর আমার করা অভিযোগ বাতিল বলে গণ্য হত। আম্মুর বক্তব্য ছিল__ ‘ইভার মতো ভাল মেয়ে পৃথিবীতে আর একটাও নেই। সে যা বলে সত্য বলে। মিথ্যা কথা বলা বা আমার উপর টর্চারিং করার মেয়ে সে নয়’। আম্মু তো আমার কথা বিশ্বাস করত’ই না, বরং ইভা যখন আমাদের বাসায় আসতো, আম্মু ভাল ভাল খাবার আর আমার জন্য বাবার পাঠানো চকলেট ইভার সামনে বের করে দিত। মাঝে-মধ্যে আম্মুকে দেখতাম, তাকে মুখে তুলে খাবার  খাইয়ে দিতে। অথচ আমি যেদিন থেকে স্কুলে যাওয়া শুরু করছি, সেদিন থেকে নাকি আমি বড় হয়ে গেছি! তাই এরপর থেকে আমাকে নিজ হাতেই খাবার খেতে হয়।

একদিন স্কুল শেষে আমি আমার বন্ধুদের সাথে ঘুরতে বের হলাম। সারাদিন টই টই করে সন্ধ্যা বেলা বাসায় ফিরে দেখলাম, আমার রুমে লাল রঙের সুন্দর এক জোড়া বুট জুতা। আমি আম্মুকে ডেকে জিজ্ঞেস করলে রান্না ঘর থেকে উওর আসলো__ ‘জুতোটা ইভা তোকে গিফট করেছে।’ কথাটা আমার মাথার উপর দিয়ে চলে গেল। মাথার ভেতরে আর কিছুই ঢুকলো না। যে কিনা আমাকে দু’চোখে দেখতে পারে না, সে এত সুন্দর এক জোড়া বুট জুতা গিফট করেছে। বিষয়টা কেমন যেন ভাবতেও অবাক লাগছে! 

তবে যাই হোক! বিষয়টা নিয়ে পড়ে ভাবলেও হবে। কারণ পেটে অনেক ক্ষুধা, সারাদিন প্রায় না খাওয়া। তাই তাড়াতাড়ি ফ্রেস হয়ে কিছু খাবার খেয়ে নিলাম।

সারাদিন টই টই করে শরীর ক্লান্ত লাগছিল। তারপরও ক্লান্ত শরীর আর ঘুম ঘুম ভাব নিয়ে পড়ার টেবিলে বসলাম। কারণ এখন যদি পড়ার টেবিলে না বসি, তাহলে আম্মুর হাতের চড়-থাপ্পর একটাও আর মাটিতে পড়বে না! কারণ সারাদিন বাসায় নেই। তার উপর আবার না খাওয়া অবস্থায়।

পড়ার টেবিলেই কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি, নিজেও জানি না। সকাল সাড়ে সাতটায় আম্মুর ডাকে ঘুম ভাঙলো। ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করতে বসলে আম্মু বলল__’ইভা অনেক অসুস্থ, তোকে কি যেন বলবে। তাই তোকে ওদের বাসায় যেতে বলেছে।’ আমি কথাটা শুনেও না শুনার ভান করে নাস্তা করতে লাগলাম। কারণ ইভার সুস্থতায় বা অসুস্থতায় আমার কিছু যায় আসে না।

আমি নাস্তা শেষ করে স্কুল ড্রেস পরে বের হতেই আম্মু বলল_ দাঁড়া, আমিও যাবো!

_কোথায় যাবে তুমি?

_ইভাদের বাসায়।    

_আমি তো ওদের বাসায় যাচ্ছি না! স্কুলে যাচ্ছি।

_জানি, তবে যাওয়ার আগে ওর সাথে দেখা করে যাবি। চল!

কোন উপায় না পেয়ে বাধ্য ছেলের মত আম্মুর সাথে ইভাদের বাসায় যেতে হল। গিয়ে দেখি ইভা বিছানায় শুয়ে মাথায় জল পট্টি নিচ্ছে। ইভার আম্মু চেয়ার টেনে আমাদেরকে বসতে দিল। ইভা আমার দিকে তাকিয়ে স্নিগ্ধ মায়াবী একটা হাসি উপহার দিয়ে জিজ্ঞেস করল_ কিরে কেমন আছিস?

তার হাসিটা আমার কাছে কেমন যেন বিস্ময়কর ও রহস্যজনক বলে মনে হলো। কারণ আমার দিকে তাকানোর সময় যার চোখ বড় বড় হয়ে যায়, চেহারায় রাক্ষসী রাক্ষসী ভাব আসে, আর সে কিনা আমাকে দেখে এত সুন্দর মায়াবী হাসি। যেটা আমি কোন দিন স্বপ্নে দেখা তো দূরের কথা, স্বপ্নের মধ্যে কল্পনাও করিনি। আবার গতকালকের বুট জুতা গিফট!

_কিরে কথা বলছিস না কেন? কেমন আছিস? আমি ভাবছিলাম তুই হয়তো আসবি না। আচ্ছা জুতাটা পছন্দ হয়েছে তোর?

–হুম

_ধন্যবাদ তো দিলিনা?

_থ্যাঙ্ক ইউ

_স্কুলে যাবি এখন?

_হুম

এরপর ইভা best of luck বলে বালিশের নিচ থেকে একটা কাগজ বের করে আমার হাতে দিল। আমি কাগজটা ভাঁজ করে পকেটে রেখে, ওদের বাসা থেকে বের হয়ে সোজা স্কুলের পথ ধরলাম।

স্কুল ছুটি হলে বাসার পথে পা বাড়ালাম। আকাশে সাজঁ জমেছে। নাহ! ধারণাটা ভুল। সন্ধ্যে নয় বরং আকাশে মেঘ জমেছে বৃষ্টি নামবে বলে। প্রচন্ড বাতাস বইছে। রাস্তার পাশের কলাগাছ গুলো দুলছে। বৃষ্টির পূর্বে বাসায় পৌঁছানোর জন্য আমি হাটার গতি বাড়িয়ে দিলাম। কিন্তু ইভাদের বাসার সামনে আসতেই আমার পা স্থির হয়ে গেল। ওদের বাড়ির উঠানে প্রচুর ভিড়। কি যেন হয়েছে! হয়তো ইভার দাদা শরীফ মিয়া তার পুরাতন পিতলের কলসি গুলো বিক্রি করে দিচ্ছে। তাই বলে এত ভিড়? আমার বুকটা কেঁপে উঠল। একটা ভয় সারা দেহে ছড়িয়ে পড়ল। ভিড় ঠেলে দ্রুত সামনে এগুলাম। আগরবাতির ঘ্রাণে পেটের ভেতরটা কুঁকড়ে উঠল। শরীরে তীব্র ঠান্ডা অনুভব করলাম। মস্তিষ্কের নার্ভ গুলো অসাড় হয়ে আসল। এমন সময় আমার কাঁধে পরিচিত কারোর হাত অনুভব করলাম। পাশ ফিরিয়ে দেখি আম্মু। তারপর কানের কাছে ফিসফিস করে বলল_ ‘ইভা কিছুক্ষণ আগে মারা গেছে’! এই কথাটা এখনো আমার কাছে স্বপ্ন মনে হয়। তখন খুব করে কান্না করতে ইচ্ছে করছিল আমার, কিন্তু কাঁদতে পারছিলাম না।

এমন সময় ইভার দেওয়া সেই কাগজটার কথা মনে পড়ল। আমি কাগজটা পকেট থেকে বের করে খুলে দেখি, তাতে লেখা রয়েছে___

‘রাত একটা বাজে। চোখে একটু ঘুম নেই। হাত পা কাপছে, দাঁড়াবার মত শক্তিও নেই। কিছুই ভালো লাগছে না। বারবার শুধু তোর কথাটাই মনে পড়ছে। হয়তো আমার লেখাটা পড়তে তোর কাছে বিরক্তকর মনে হবে, তবুও তোকে নিয়ে লিখতে বসলাম। 

আমার জীবনে পাওয়া তুই একজন শ্রেষ্ঠ বন্ধু। আমি জানিনা কিভাবে বন্ধুত্ব করতে হয়, আর কিভাবে বন্ধুত্ব করলে ছেড়ে যায় না। তবে তোকে অনেক মিস করি, সেটা খুব ভালোভাবে বুঝতে পারি। তোর রাগ মিশ্রিত মায়াবী চেহারা আমার কাছে অনেক ভালো লাগে। তাই বারবার তোর সাথে ঝগড়া করে, তোকে রাগানোর চেষ্টা করি। তোকে নিয়ে ক্লাসের মেয়েদের কাছে সমালোচনা করি, যাতে করে ওরা কেউ কোনদিন তোর দিকে আকৃষ্ট না হয়। আর এসব করি, কারণ…… না, থাক ! কারণটা তোর অজানাই থাক। তবে Promise করছি, কোন দিন তোর জায়গাটা অন্য কারো দিবো না।

___ ইভা

দাফন শেষ হলো। সবাই যার যার মতো চলে যাচ্ছিল। চারিদিকে অন্ধকার হয়ে সন্ধ্যা নেমে আসলো। আমি কবরে বেড়া ধরে অনেক সময় দাঁড়িয়ে ছিলাম। সে দিন আকাশে খুউব মেঘ জমেছিল। মেঘগুলোকে ভয়ঙ্কর সুন্দর লাগছিল। ঘন ঘন বজ্রপাতও হচ্ছিল। বৃষ্টি হবে হবে বোধহয়, কিন্তু হচ্ছিল না। তীব্র বাতাসে কবরস্থানের বটগাছটার পাতা বিচিত্র রকমের শব্দ তুলেছিল। খুব বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছে করেছিল, কিন্তু সেদিন আর বৃষ্টি হয়নি। 

আমি একদিন থাকবো না 

তবে খুঁজবে কি আমায়?

স্মৃতিগুলো কি রাখবি মনে?

জড়াবি কি স্মৃতির মায়ায়?

আমার সম্পর্কে

আমি ছফওয়ান আল মুসাইব, একজন 3D আর্টিস্ট, ভিডিও এডিটর। 3D আর্টের প্রতি গভীর ভালোবাসা থেকেই আমি আমার ক্যারিয়ার শুরু করি, এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজের দক্ষতা গড়ে তুলেছি। পেশাগত জীবনে সাফল্যের পাশাপাশি আমি গল্প লেখা এবং ভ্রমণে দারুণ আগ্রহী। শখের বসে মাঝে মাঝে হাতে কলম তুলে নিই এবং আমার মনের ভাবনা ও অনুভূতিগুলোকে শব্দে রূপ দিই। আমার লেখা গল্পগুলো বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছে, যা অনেক পাঠকের হৃদয় ছুঁয়ে গেছে।

জনপ্রিয় পোস্ট

সাম্প্রতিক পোস্ট