ছফওয়ান আল মুসাইব

একগুচ্ছ ফুলের দামে আলো

একগুচ্ছ ফুলের দামে আলো

অন্ধকারে ঢাকা শহরের ছোট্ট একটি রাস্তা। আকাশে ঘন মেঘের চাদর, তারাদের দেখা পাওয়া যেন একরকম দুঃস্বপ্নের মতো—খুব সামান্য সময়ের জন্য আসে, আবার হারিয়ে যায়। রাত গভীর হলেও শহরের কোলাহল থামেনি। রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে আছি আমি, নির্দিষ্ট কোনো উদ্দেশ্য নেই, তবুও মনটা ভারাক্রান্ত। শহরের মানুষজন, গাড়ির শব্দ, সব যেন আমার চারপাশ দিয়ে দ্রুত চলে যাচ্ছে, কিন্তু আমি যেন সম্পূর্ণ আলাদা—একাকী, নিঃসঙ্গ। চারপাশের কোলাহল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মনে অদ্ভুত এক বিষণ্ণতা ঘিরে ধরেছে আমাকে।

ঠিক তখনই, হঠাৎ থেমে গেল আমার চিন্তার ধারা। রাস্তার বিপরীত পাশে দৃষ্টি গেল, সেখানে দাঁড়িয়ে আছে একটি ছোট্ট শিশু। বয়স পাঁচ কিংবা ছয় হবে। তার হাতে একগুচ্ছ ফুল, যা বিক্রির চেষ্টা করছে। কিন্তু তার চেহারা দেখলে মনে হয়, জীবন তাকে এই বয়সেই পরিপূর্ণ দায়িত্বের ভার চাপিয়ে দিয়েছে। জীর্ণশীর্ণ জামা-কাপড়, ক্লান্ত শরীর, আর তার চোখে ফুটে থাকা এক অসীম আকুতি। শিশুটির মলিন চেহারা যেন বলে দিচ্ছিল, সে জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে সংগ্রাম করে যাচ্ছে।

ছেলেটি রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকলেও যেন চারপাশের কারও নজরে আসছে না। শহরের ব্যস্ততা আর ভিড়ের মাঝে তার উপস্থিতি একেবারেই উপেক্ষিত। পথচারীরা তার পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে, গাড়িগুলো দ্রুতগতিতে গন্তব্যের দিকে ছুটছে, কিন্তু কেউ ফিরেও তাকাচ্ছে না তার দিকে। শিশুটি আশা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তবে তার চোখে জমে উঠছে হতাশা—কেউ কি তার থেকে একটি ফুলও কিনবে?

আমি দূর থেকে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম, তার মলিন চোখের দিকে তাকিয়ে। ছেলেটি নীরবে চেষ্টা করছে, কিন্তু কেউ তার পাশে থামে না, কেউ তার ফুল কিনছে না। হতাশ মুখে সে দাঁড়িয়ে আছে, যেন জীবনের সমস্ত আশা একে একে হারিয়ে ফেলেছে। আমার বুকের ভেতর অদ্ভুত এক কষ্টের ঝড় বয়ে গেল। কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম তার দিকে।

‘এই খোকা, সবগুলো ফুল কত টাকা?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম।

ছেলেটি থতমত খেয়ে গেল। হয়তো ভাবছে আমি তার সাথে মজা করছি। মুখে কোনো কথা নেই, শুধু অমলিন ঠোঁট আর পাথরের মত ঘোলাটে দু’টো চোখের দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আমার দিকে। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম___ ‘খোকা, সবগুলো ফুল কত টাকা?’ ছেলেটি এবার হতবাক হলো! যেন সে ভাবতে পারেনি কেউ তার ফুল কিনতে চাইবে। ধীরে ধীরে সে বলল____ ‘আপনি সব ফুল কিনবেন?’

আমি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললাম___ ‘হ্যাঁ, সবগুলো।’

এই কথাটি শোনার পর ছেলেটির মুখে এক অদ্ভুত আনন্দের ঝিলিক ফুটে উঠল, যে হাসিতে ছিল এক অনির্বচনীয় স্বস্তি। আমি পকেট থেকে টাকা বের করে তার হাতে দিলাম। কয়েক মুহূর্তের জন্য সে হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর ধীরে ধীরে তার চোখে জল জমে উঠল, সেই জল ছিল আনন্দের, বিস্ময়ের আর কৃতজ্ঞতার এক মিশ্র প্রতিক্রিয়া। তার ছোট্ট মুখে এক অনির্বচনীয় প্রশান্তির ছাপ ফুটে উঠল, যেন এই একটি মুহূর্তেই তার সমস্ত দুঃখ-কষ্ট ঘুচে গেছে। সে কাঁপা গলায় বলল, ‘আপনি জানেন, আমার মা খুব অসুস্থ। সারাদিন কোনো ফুল বিক্রি হয়নি। মা’কে ওষুধ কিনে দিতে পারব বলে ভাবতেও পারিনি। আপনি আমার সব ফুল কিনে নিলেন, এখন আমি মা’কে ওষুধ কিনে দিতে পারব।’

ছেলেটির এই কথাগুলো শুনে আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। একটা ছোট্ট ফুলের বান্ডিল কিনে এত বড় উপকার করা যাবে, সেটা আমি আগে ভাবিনি। জীবনের এই ছোট্ট মুহূর্তে ছেলেটির চোখে আমি যেন কৃতজ্ঞতার সবটুকু প্রকাশ দেখলাম। তার সাথে আর কোন কথা না বলে চুপচাপ হাঁটা শুরু করলাম।

হাঁটতে হাঁটতে মনটা ভারী হয়ে উঠল। ভাবতে থাকলাম___ এ শহরের প্রতিদিনের চাঞ্চল্যের মধ্যে কত অদেখা কষ্ট লুকিয়ে থাকে, যেগুলো আমরা কখনো চোখেও দেখি না। হয়তো এই ছেলেটির মতো হাজারো মানুষ তাদের দৈনন্দিন জীবন সংগ্রামে লিপ্ত থাকে, কিন্তু আমরা নিজেদের ব্যস্ততার ফাঁকে তাদের কষ্টকে বুঝতে পারি না। আজ আমি হয়তো একটি ছোট্ট ফুলের বান্ডিল কিনে তাকে সাহায্য করতে পেরেছি, কিন্তু এই ছোট্ট ঘটনা আমার কাছে জীবনের একটি বড় শিক্ষা হয়ে রইল।

আমাদের জীবনের কঠোর বাস্তবতা ও কোলাহলমুখর জীবনের মাঝেও কখনো কখনো আমাদের থেমে গিয়ে চারপাশের মানুষের দিকে তাকানো উচিত। সেই ছোট্ট ছেলেটির কষ্ট আমাকে ভাবিয়েছে___ আমরা প্রতিদিন নিজেদের জীবনের দৌড়ে এত ব্যস্ত হয়ে পড়ি যে, অন্যের দুর্দশার প্রতি চোখ বন্ধ করে চলি। হয়তো এই ছোট্ট মুহূর্তটি আমাদের শেখায়___ মানবতা ও সহানুভূতি সবকিছুর ঊর্ধ্বে, এবং আমরা নিজেদের মতো করে যদি অন্যকে একটু সাহায্য করতে পারি, তবেই জীবনটা হয়ে উঠবে আরো সুন্দর।

আমার সম্পর্কে

আমি ছফওয়ান আল মুসাইব, একজন 3D আর্টিস্ট, ভিডিও এডিটর। 3D আর্টের প্রতি গভীর ভালোবাসা থেকেই আমি আমার ক্যারিয়ার শুরু করি, এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজের দক্ষতা গড়ে তুলেছি। পেশাগত জীবনে সাফল্যের পাশাপাশি আমি গল্প লেখা এবং ভ্রমণে দারুণ আগ্রহী। শখের বসে মাঝে মাঝে হাতে কলম তুলে নিই এবং আমার মনের ভাবনা ও অনুভূতিগুলোকে শব্দে রূপ দিই। আমার লেখা গল্পগুলো বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছে, যা অনেক পাঠকের হৃদয় ছুঁয়ে গেছে।

জনপ্রিয় পোস্ট

সাম্প্রতিক পোস্ট