ঘড়ির কাঁটা রাত এগারোটা ছুঁই ছুঁই। পল্টন ফ্লাইওভার ব্রিজের নিচে দাঁড়িয়ে আছি। ফিস-ফিস করে বৃষ্টি হচ্ছে। আশ-পাশে কোন খালি রিক্সাও দেখছি না। বৃষ্টির কারণে তারা হয়তো রিক্সটা রাস্তার পাশে রেখে, বৃষ্টির সাথে পাল্লা দিয়ে ধোঁয়া উড়াতে ব্যস্ত। আবার কেউ হয়তো কোন চা স্টলের নিচে দাঁড়িয়ে, বাম হাতে এক কাফ রং চা নিয়ে দেশের হাল-হাকিকত তথা রাজনীতি নিয়ে সলা পরামর্শ করছে। আমাদের দেশের প্রতিটি চা স্টল’ই যেন আন্তর্জাতিক সংসদ ভবন, যেখানে সারা পৃথিবীর সমস্ত বিষয় নিয়ে’ই পর্যালোচনা করা হয়। কোন ইস্যু বাদ যাওয়ার সুযোগ নেই। মাঝে মধ্যে তারা আজগুবি আজগুবি এমনও কথা-বার্তা বলে, যা শুনলে মনে হয় যেন ‘তারাই দেশের কর্ণধার’। দেশের সব দায়-দায়িত্ব তাদের উপর নেস্ত করে, সরকার এখন অবসরে আছেন। তবে সব রিক্সাওয়ালা আবার এমন না। অনেকেই আছে যারা দ্বীন মেনে চলার চেষ্টা করে।
যেমন গত কয়েকদিন আগে একটা রিকশায় উঠে ছিলাম। ওই ভদ্রলোক নাকি আগে ব্যাংকে চাকুরি করতেন। এখন রিক্সা চালায়। কথা বলে বুঝতে পারলাম, একেবারে সহজ সরল প্রকৃতির মানুষ। কামাই রোজগারের পরিমাণ খুব বেশি না হলেও, আগের থেকে নাকি এখন সুখে আছে। এক সুনামধন্য আলেমের বয়ান শুনে ব্যাংকের চাকুরী ছেড়ে দিয়েছে। এখন সৎ ভাবে আয়-উপার্জন করে। নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, কালামসহ ইসলামের আনুষাঙ্গিক বিধি-বিধানগুলোও ঠিকঠাক মতো আদায় করার চেষ্টা করে। এককথায় যথার্থ ধর্মপরায়ণ একজন মানুষ।
কিছু সময় পর বৃষ্টি থেমে গেলে একটা রিক্সার সাক্ষাৎ মিললো। ভাড়া ঠিক করে রিক্সায় চেপে বসলাম। মিনিট পাঁচেক যেতে না যেতেই বিশাল এক জ্যামের মুখো-মুখি হলাম। পুরান ঢাকার এই বিষয়টা খুবই অবাক লাগে। যেন সময়ের কোন টাইম-টেবিল নেই। যে কোন সময়, যে কোন জায়গায় জ্যাম লেগে যায়। এটা যেন পুরান ঢাকার এক ঐতিহ্য। কি আর করার! জ্যামে বসে আকাশ দেখতে লাগলাম। সে আমার খুব প্রিয়। আমার মন খারাপের দিনগুলোতে প্রিয় আকাশটার সাথে আমার খুব ভাব জমে যায়। ঘন্টার পর ঘন্টা আকাশের সাথে সময় কাটানো হয়। যদিও শহরের উঁচু-নিচু বিল্ডিংয়ের কারণে প্রিয় আকাশটাকে বেশি একটা দেখতে পাইনা, তারপরও যতটুকু চোখে পড়ে। এমন সময় পাশে হঠাৎ করে কেউ বলে উঠলো_ ‘ভাইয়া এক বোতল পানি কিনবেন?’ আমি আকাশের দিকে দৃষ্টি রেখে’ই ‘না’ বলে দিলাম। কিছুক্ষণ পর অনুভব করলাম ছেলেটি এখনো দাঁড়িয়ে আছে। আচ্ছা! দাঁড়িয়ে থাকলে থাক। তার দাঁড়িয়ে থাকা দিয়ে আমার কোন কিছু যায়-আসে না। কিন্তু পরক্ষণে আবার আওয়াজ ভেসে আসলো, ‘ভাইয়া এক বোতল পানি নিন না! বাড়িতে আম্মু খুবই অসুস্থ। ওষুধ কেনার মত কোন টাকা নেই। নিন না এক বোতল পানি!’
ছেলেটার মুখে মায়ের অসুস্থর কথা শুনে এক মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেলাম। তার দিকে তাকিয়ে আরো বেশি আশ্চর্য হয়ে গেলাম। সাত সাড়ে সাত বছরের একটা ছেলে। শরীরে অর্ধ ছেঁড়া একটা জামা। দু’চোখে পানি। ভাবতেই আবাক হয়ে গেলাম_ ‘এতটুকু একটা ছেলে জীবিকার তাগিদে রাস্তায় রাস্তায়, বাসে বাসে পানি বিক্রি করে।’ জিজ্ঞেস করলাম, চোখে পানি কেন তোমার ?
ছেলেটি আমার দিকে অপলক দৃষ্টিতে এক নজর তাকিয়ে, কোন কথা না বলে হাঁটা শুরু করল। আমি রিকশা থেকে নেমে পিছন থেকে ছেলেটার হাত ধরলাম। আবার জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমার চোখে পানি কেনো?’ ছেলেটি কোন কথা বললো না। জীর্ণ হহহহহ এবং ক্ষুধার্ত চেহারা নিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। আমি ছেলেটাকে নিয়ে রাস্তার পাশে থাকা এক রেস্টুরেন্টে ঢুকলাম।
জিজ্ঞেস করলাম, কি খাবা?
_বিরিয়ানি।
আমি বিরিয়ানি অর্ডার দিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে বিরিয়ানির প্লেট আমাদের সামনে উপস্থিত হলো। ছেলেটি বলল; ‘ভাইয়া আমি এখন এটা খাবো না।’
_কেন?
_বাড়িতে আম্মু সারাদিন কিছুই খাইনি। আমি এটা নিয়ে আম্মুর সাথে খাব।
আমি ছেলেটিকে বললাম_ ‘তুমি এটা খাও, তোমার আম্মুর জন্য আরেকটা অর্ডার দিচ্ছি। সেটা নিয়ে যেও।’ কথাটা শুনে ছেলেটি খেতে শুরু করলো।
খাওয়া শেষ হলে জিজ্ঞেস করলাম_ নাম কি তোমার?
_আবির
_তোমার চেহারা-সুরত, আর কথা-বার্তা শুনে মনে হচ্ছে তুমি কোন শিক্ষিত ফ্যামেলির ছেলে। পড়ালেখা করো না?
_আগে পড়তাম, এখন পড়ি না।
_কেন?
আমার প্রশ্ন শুনে ছেলেটা চুপ হয়ে গেল। চোখ দু’টো আবার পানিতে ভিজে গেল। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পরে বলল_ আম্মু অনেক অসুস্থ। চিকিৎসা করার জন্য অনেক টাকার দরকার। তাই পড়াশোনা বাদ দিয়ে দিয়েছি।
_তোমার বাবা কি করে ?
বাবার কথা জিজ্ঞেস করতেই ছেলেটি শোকে ভেঙে পড়লো এবং কান্নায় বাকরুদ্ধ হয়ে কাঁদতে লাগলো। ওর কান্না দেখে আমার মনটা গভীর দুঃখে ভরে গেল, ওর বেদনা আমি গভীরভাবে অনুভব করলাম। মনে হচ্ছিল ওর দুঃখটা আমারও বুক চেপে ধরেছে, তার এই কষ্ট আমার মনে গভীর ছাপ ফেলল।
ছেলেটি কিছু সময় চোখের পানি বিসর্জন দিয়ে বলল_ ভাইয়া আমার বাবা মারা গেছে প্রায় দু’বছর হতে চলছে। হয়তো আপনি এখন জিজ্ঞেস করবেন_ কিভাবে? সে এক লম্বা ইতিহাস। বলতে গেলে অনেক সময় লাগবে। এই গরিবের দুঃখের কাহিনী শুনার মত ধৈর্য এবং সময় হয়তো আপনার কাছে হবে না।
আমি বললাম_ সমস্যা নেই! আমি ফ্রি আছি। তুমি চাইলে বলতে পারো। কারণ মানুষের কাছে দুঃখ, কষ্ট শেয়ার করলে, মনটা হালকা হয়। তাছাড়া তোমার আম্মু যদি বাস্তবেই অসুস্থ হয়, আর তুমি যদি এই বিষয়ে আমাকে সত্য বলো। তা’হলে আমি আমার সাধ্য মতো তোমাদের পাশে দাড়ানোর চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ!
ছেলেটি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল_ ভাইয়া পৃথিবীতে বিশ্বাস নামক জিনিসটা এখন আর নাই। কেউ কারো কথা বিশ্বাস করতে চায় না। আর বিশ্বাস করবেই বা কীভাবে ? সবাই প্রতারণার শিকার। যে যাকে পারছে, যেভাবে পারছে ঠকানোর চেষ্টা করছে। চারিদিকে মিথ্যার জয় জয়কার। হয়তো আপনিও আমার কথা বিশ্বাস করছেন না বা করবেন না। তবুও যেহেতু শুনতে চাচ্ছেন আমার জীবনে দুঃখ-কষ্ট, তা’হলে শুনুন_
‘আমাদের পরিবারের সদস্য সংখ্যা ছিলো চার জন। আমি বাবা-আম্মু আর আপু। চার সদস্য বিশিষ্ট আমাদের পরিবারটি খুব হেপ্পি ছিল। বাবা একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে জব করত। আর আম্মু বাড়িতে আমাদের দেখা-শোনা করত। সব মিলে আমাদের একটি সাজানো-গোছানো পরিবার ছিল। কিন্তু এই সুখ শান্তি আমার কপালে বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। কালবৈশাখী এক ঝড় এসে সবকিছু তছ-নছ করে দিয়ে যায়। নিভে যায় এক মুহূর্তের মধ্যে আমার ‘জীবন প্রদীপ’। হয়ে যায় আমার স্বপ্নের পৃথিবী উল্টা-পাল্টা।
আপু তখন ক্লাস নাইনে পড়ে আর আমি সবেমাত্র স্কুলে আসা-যাওয়া শুরু করেছি। একদিন সকালে বাবার চিল্লা-চিল্লির আওয়াজে আমার ঘুম ভাঙে। এর আগে কখনো বাবাকে এত জোরে জোরে কথা বলতে দেখিনি। রাগে দু’চোখ লাল হয়ে গেছে। বাবার চিল্লানোর কারণ ছিল_ আমাদের এলাকার চেয়ারম্যান ক্ষমতার জোরে গরীব অসহায় মানুষগুলোর জমি-জায়গা দখল করে নেয়। সেই অসহায় হতভাগাদের মধ্যে বাবার অফিসের দারোয়ানও ছিল। দারোয়ান নাকি বাবাকে অনেক শ্রদ্ধা করত। এই কারণে সময় সুযোগ হলে বাবা তাঁর দুঃখ কষ্টগুলো বুঝার চেষ্টা করত। প্রয়োজন মনে হলে সহযোগিতারও হাত বাড়িয়ে দিত। সেই সুবাদে দারোয়ান বাবাকে বিষয়টা অবগত করলে, বাবা দারোয়ানকে সাথে নিয়ে চেয়ারম্যানের নামে একটা মামলা করে। পরে সেদিন সকালে চেয়ারম্যান এবং তার লোকজন এসে বাবাকে মামলা তুলে নিতে বলে। বাবা মামলা তুলে নিতে অস্বীকার করলে, তারা বাবাকে মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে যায়। আমার ঘুম থেকে ওঠা দেখে আম্মু বলল; ‘দয়া করে এবার চুপ করো, ছেলে উঠে পড়েছে’। বাবাও আর কোন কথা না বলে, গোসল শেষ করে প্রতিদিনের মতো আমাকে আর আপুকে আদর করে, অফিস থেকে ফেরার সময় আমার জন্য কী কী আনতে হবে, সে সব বায়নাগুলো শুনে অফিসের ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে পড়ল।
সকাল গড়িয়ে দুপুর হল। বাবারও বাসায় ফিরার সময় হয়ে গেল। বাবা প্রতিদিন দুপুর দু’টার মধ্যে বাসায় ফিরে আসত, এরপর আমরা সবাই এক সাথে খাবার খেতাম। কিন্তু বাবা সেদিন আর এলো না। আম্মু বাবাকে ফোন দিলে, ফোনটা সুইচ অফ দেখাল। আমরা ভাবলাম হয়তো চার্জ শেষ হয়ে গেছে। তাই বাবার জন্য আরো কিছু সময় অপেক্ষা করলাম। কিন্তু বাবার আসার কোন আলামত পেলাম না। এভাবেই দুপুর গড়িয়ে বিকাল হতে শুরু করল। আম্মু চিন্তায় অস্থির হয়ে গেল। এত দেরি তো কোন দিনও করে না। তাহলে কি সত্যি চেয়ারম্যান আর তার লোকজন বাবাকে মেরে …..। নাকি অফিস থেকে আজ এখনো ছুটি হয়নি। আম্মু বাবার অফিসে ফোন দিলে সেখান থেকে জানানো হল, বাবা আজকে অফিসে যায়নি। আম্মু কথাটা শুনে কিছু সময়ের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল। এরপর আমাদের যত আত্মীয়-স্বজন ছিল, সব জায়গাতে ফোন দিয়ে আম্মু খোঁজ করল। কিন্তু কোথাও বাবার সন্ধান পেল না। আমার একটা মাত্র চাচা। বিষয়টা তাকে জানানো হলে সে বলল; ‘তোমরা চিন্তা করো না, হয়তো কোথাও কোন কাজে আটকে পড়েছে, কাজ শেষ হলে চলে আসবে।’
আম্মু সন্ধ্যার সময় থানায় গেল। কিন্তু কোন লাভ হল না। তারা আম্মুকে সাহায্য করা তো দূরের কথা, বরং আম্মুকে অপমান করে পাঠিয়ে দিল। আম্মু চিন্তা টেনশনের সারা রাত না ঘুমিয়ে বাবার অপেক্ষায় বসে রইল। কিন্তু বাবা রাত্রেও ফিরে এল না। পরের দিন আম্মু নিজে’ই বাবার খোঁজে বেরিয়ে পড়ল। বাবার অফিস, দারোয়ানের বাসা, চেয়ারম্যান আর তার লোকজনের বাড়ী সব জায়গাতে’ই খোঁজ করল, কিন্তু কোথাও বাবার সন্ধান পেল না। সন্ধ্যাবেলা হতাশা চেহারা নিয়ে ফিরে এল।
এভাবেই একদিন দু’দিন শেষ হয়ে, সপ্তাহ অতিক্রম হয়ে গেল। কিন্তু বাবা ফিরে এলো না। চিন্তা টেনশনে আম্মুর শরীর অসুস্থ হয়ে গেল। আমি তখন তেমন কিছু বুঝতাম না। তবুও সারাদিন যেমন তেমন কেটে যেত, কিন্তু রাতের বেলায় বাবার কথা খুব মনে পড়ত। আর দু’চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় পানি ঝরত। প্রতিদিন আপু আমার চোখের পানি মুছে দিয়ে, এটা বলে সান্ত্বনা দিত যে, ‘এই তো ভাইয়া, বাবা দেখবে কাল সত্যি সত্যি চলে আসবে। বাবা আমাদের না বলে ঢাকার শহরে গেছে। কেন জানো? এসে তোমাকে সারপ্রাইজ দেবে বলে। তোমার জন্য অনেক মজা আর খেলনা আনতে গেছে। কাল দেখবে সত্যি’ই বাবা চলে আসবে’। কিন্তু বাবা আর কাল আসতো না।
আম্মু খেয়ে না খেয়ে সারা দিন বাবার খোঁজ করে বেড়াত, আর রাতের বেলা না ঘুমিয়ে দরজার পাশে বসে থাকত। এই বুঝি তার প্রাণ প্রিয় এলো। ঠিক মতো না খাওয়া, না ঘুমানোর কারণে আম্মু মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলল। আম্মুকে বুঝিয়ে সান্ত্বনা দেওয়ার মতো বা বিশেষ করে এমত অবস্থায় আমাদের পাশে দাঁড়ানোর মত কোন মানুষ ছিল না। আশ-পাশের প্রতিবেশীরা এসে, প্রতিদিন আম্মুকে কিছু সান্তনার বাণী শুনিয়ে হক আদায় করে যেত। আর এদিকে চাচা! সে সহযোগিতা করা তো দূরের কথা, বরং আম্মুকে দোষা-রোপ করতে থাকে। এমনকি আম্মুকে কয়েকবার এটাও বলেছে যে, ‘তুই আমার ভাইকে মেরে লাশ গুম করে, এখন পথে পথে তাঁকে খোঁজার নাটক করছিস। আমি তোর নামে থানায় মামলা করব’।
১৫ দিনের মাথায় আম্মু ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়ল। এতটাই অসুস্থ হল যে, একা একা চলার শক্তি হারিয়ে ফেলল। ডাক্তার ডাকা হলে, চেক-আপ করে বলল; ঠিক মতো না খাওয়া এবং না ঘুমানোর কারণে এমনটা হয়েছে। পুষ্টিকর খাবার খেলে এবং ঠিক মতো ঘুমালে সুস্থ হয়ে যাবে। আপু আম্মুকে বুঝিয়ে শুনিয়ে যা দু’ এক লোকমা খাবার খাওয়াতো, কিন্তু ঘুম আর পাড়াতে পারত না। আম্মুকে ঘুমানোর কথা বললে আম্মু বলত; ‘আমি যদি ঘুমিয়ে যাই, আর তোর বাবা এসে যদি আমাদেরকে ডাক দেয়, আর আমরা যদি ঘুমিয়ে থাকার কারণে না শুনতে পাই, উঠতে না পারি, তাহলে তোর বাবার কষ্ট হবে না? যা যা তোরা ঘুমিয়ে পড়’।
এভাবে দিন শেষ হয়ে সপ্তাহ, সপ্তাহ শেষ হয়ে মাস অতিক্রম করলো। কিন্তু বাবা আর ফিরলো না। একদিন চাচা এসে আম্মুকে বলল_ ‘আমাদের এলাকার পুলিশ তো চেয়ারম্যানের সাইন ছাড়া কোন কাজ করে না। আর যেহেতু তোমাদের ঝামেলাটা হয়েছে চেয়ারম্যানের সাথে, তাই এই থানার পুলিশ আমাদেরকে কোন সাহায্য করবে না। এখন ভাইকেও তো খুঁজতে হবে। তাই আমি চিন্তা-ভাবনা করছি, ভাইকে খোঁজার জন্য শহর থেকে স্পেশাল পুলিশ ফোর্স আনব। এর জন্য অনেক টাকার প্রয়োজন। আমার কাছে তো এত টাকা নেই। তোমাদের ঘরে টাকা-পয়সা যা আছে সব নিয়ে এসো’। আম্মু চাচার কথায় বিশ্বাস করে, ঘরে বাবার জমানো যত টাকা ছিল এবং আম্মুর যত অলংকার ছিল, এমনকি আপুর স্কুল টিফিন থেকে বাঁচানো টাকাও বাবাকে ফিরে পাওয়ার আশায়, চাচার হাতে এনে দিল। চাচা একটা কাগজ বের করে বলল_ ‘আবিরের বাবা যে সত্যি সত্যি নিখোঁজ, তার একটা ডকুমেন্ট দরকার। তাই এই কাগজে স্বাক্ষর করা লাগবে’। আম্মু সাত পাঁচ ভেবে, কোন কিছু না দেখে কাগজে সাইন করে দিল।
পরের দিন সকালে চেয়ারম্যান আর তার লোকজন আমাদের বাড়ীতে এসে আম্মুকে বলল_ ‘তোমরা কাল থেকে রেললাইনের পাশে যে বস্তি রয়েছে, ওখানে থাকবে। আম্মু ‘কেন’ জিজ্ঞেসা করলে তারা বলল_’ফয়সাল (আমার চাচার নাম) আমাদের কাছে, তোমাদের সব সম্পত্তি বিক্রি করে দিয়েছে। তাই তোমাদের সব সম্পত্তির মালিক আজ থেকে আমারা। তোমাদের জন্য এটাই ভালো হবে যে, তোমরা আজকের মধ্যে তোমাদের বাড়ি ছেড়ে বস্তিতে চলে যাবে। আর তা না হলে তোমাদের ঘাড় ধাক্কা দিয়ে আমরা বের করে দিব। তখন বাড়িও হারাবে, বস্তিও হারাবে।’ আম্মু তাদের কথা-বার্তা শুনে জ্ঞান হারিয়ে ফেলল। আপু রাগে ক্ষেপে চেয়ারম্যানের মুখের দিকে পায়ের জুতা খুলে নিক্ষেপ করল। আর সাথে সাথে হিংস্র পশুর মতো জানোয়ারগুলো আপুর উপরে ঝাপিয়ে পড়লো। যেন কোন ক্ষুধার্ত শিয়ালের দলের মাঝে একটা মুরগীর বাচ্চা। ওই পাপিষ্ঠ জানোয়ারগুলো একে একে সবাই আপুকে ভোগ করতে লাগলো। আপুর চিৎকারের আওয়াজে আম্মুর জ্ঞান ফিরে এলো।
জানোয়ারগুলো মোটা একটা রশি দিয়ে আম্মুর দু’হাত পিট মোড়া দিয়ে জানালার সাথে বেধে রাখল। যেন কোন প্রতিবাদ করতে না পারে। আপুর সেদিনের ‘বাঁচাও! আমাকে এই জানোয়ারগুলোর হাত থেকে বাঁচাও’ চিৎকারগুলো বাতাসের সাথেই মিশে গেলো। চেয়ারম্যান এবং তার লোকজনের ভয়ে কেউ আপুর ইজ্জত রক্ষার জন্য এগিয়ে এলো না। জানোয়ারগুলো ইচ্ছে মতো আপুকে ভোগ করলো। শুধু এখানেই শেষ নয়। নরপশু গুলো প্রমাণ লোপাটের জন্য আপুর গায়ে পেট্রোল ঢেলে আগুন লাগিয়ে দিল। মায়ের চোখের সামনে জীবন্ত মেয়ের শরীরের ধাঁ ধাঁ করে আগুন জলতে থাকে। সে দিনের পর থেকে আজ পর্যন্ত আম্মু একটা কথাও বলেনি। বেঁচে থেকেও যেন সে জীবন্ত এক লাশ। পাপিষ্ঠগুলো চলে যাওয়ার সময় বাড়ীর আশ-পাশের প্রতিবেশীদেরকে বলে যায় যে, ‘‘এদেরকে যদি কেউ সাহায্যে করে বা আমাদের বিষয় কখনও কেউ মুখ খুলে, তাহলে তার অবস্থাও এদের বাবা আর মেয়ের মতো হবে।’’ তখন আমার আর বুঝতে বাকী রইল না_ বাবা কেন আজও বাসায় ফিরে নাই।
সন্ধ্যা বেলায় পুলিশ এসে আপুর পুড়া লাশ আর আম্মুকে ধরে নিয়ে গেল। দু’দিন পর আম্মুকে কোর্টে উঠাল। সেখানেও ঘটল এক নাটক। যার ভিলেন হলেন আমার আম্মু। আসলে বর্তমান দুনিয়াটা ভাইয়া টাকাওয়ালাদের হাতে। টাকা থাকলে মিথ্যাকে সত্য আর সত্যকে মিথ্যা বানানো কোন ব্যাপারই না। ওদের পক্ষের উকিল কোর্টে বক্তব্য রাখল_ ‘এই মহিলা (আমার আম্মু) নষ্ট চরিত্রের অধিকারী। এই জন্য তাকে নিয়ে গ্রামে কয়েকবার পঞ্চায়েতও বসেছে। নিজের স্বার্থের জন্য সে সব কিছু’ই করতে পারে। এ কারণে প্রায়’ই তার স্বামীর সাথে তার ঝগড়া হতো। এক পর্যায়ে তার স্বামী অতিষ্ঠ হয়ে বাড়ী ছেড়ে অন্য কোথায়ও চলে যায়।’ এ বিষয় নিয়ে আম্মুর বিরুদ্ধে কয়েকজন লোক সাক্ষীও দিল। তারা নাকি আমাদের প্রতিবেশী। অথচ আমি তাদেরকে কোন দিনও আমাদের গ্রামে দেখিনি।
এরপর বলল_ ‘‘এই মহিলার স্বামী বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার পর থেকে আমাদের সুনামধন্য, সমাজসেবক চেয়ারম্যান সাহেব এবং তার লোকজন এই মহিলার পরিবারকে দেখা শোনা করে আসছিল। আর সেই সুযোগে এই মহিলা চেয়ারম্যান সাহেবের সাথে অবৈধ প্রেমের সম্পর্ক গড়ে, তার সমস্ত সম্পত্তি হাতিয়ে নিতে চায়। কিন্তু আমাদের চেয়ারম্যান সাহেব তার কুটনীতি বুঝে যায় এবং তাকে শক্ত ভাবে সতর্ক করে দেয়। শুধু এখানেই শেষ নয় মহামান্য আদালত। এই যে মহিলার মেয়ে, যাকে আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। সেও তার মায়ের এই সব আচরণে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে এবং খারাপ পথ থেকে ফিরে আসতে বলে। এতে এই দাজ্জাল মহিলা অপমান বোধ করে। আর নিজের মেয়ের কাছে অপমান হওয়াটা সে একদম সহ্য করতে পারেনি। আর এই কারণে নিজের মেয়ের শরীরে পেট্রোল ঢেলে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে হত্যা করে আমাদের সম্মানিত চেয়ারম্যান সাহেবকে ফাঁসানোর চেষ্টা করে। যাকে আমরা বলি ‘এক’ই তীরে দু’ পাখি মারা।’ মহামান্য আদালতের কাছে আমি এই দাজ্জাল মহিলার জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি, যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আবেদন করছি।’’
এখন ভাইয়া আপনি’ই বলেন; পৃথিবীতে কি এমন কোন মা আছে, যে তার মেয়ের শরীরে পেট্রোল ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেবে। আমি মাঝে মধ্যে একা একা বসে ভাবি_ টাকা আর ক্ষমতা থাকলে, এই ভাবে সত্যকে মিথ্যা আর মিথ্যাকে সত্য বানানো যায়।
আমি জিজ্ঞেস করলাম_ আদালত সেই আবেদন কি মঞ্জুর করেছিল ?
_না! আদালত যাবজ্জীবন দেয়নি, তবে সাত বছরের কারাদণ্ড দিয়ে ছিল।
_পরে এরা আবার আদালতের কাছে আবেদন করল, আমার আম্মু অসুস্থ। এজন্য তাকে যেন প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে তারপর জেলে পাঠানো হয়। আদালত তাদের আবেদন মঞ্জুর করে আম্মুকে হাসপাতালে পাঠানোর নির্দেশ দিল। ওরা চেয়ে ছিলো যে, আম্মুকে চিকিৎসার নামে হাসপাতালে নিয়ে ওষুধ খাইয়ে পাগল বানিয়ে দিবে। কিন্তু ওদের এই চেষ্টা ব্যর্থ হল। হাসপাতালের এক নার্স বিষয়টি বুঝতে পেরে আম্মুকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করে। আম্মু আমাকে নিয়ে রাতের আধারে ঢাকার শহরে পাড়ি জমায়। এরপর ঢাকা শহরের জীবনের কথা আর কি বলব। দেখতেই তো পারছেন। সারাদিন পেটে খাবার নেই, শরীরে পোশাক নেই, রাতে থাকার কোন ঘর নেই। এভাবেই দিন পার করছি।
আমি ছেলেটার জীবন ইতিহাস শুনে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। আমার দু’চোখ দিয়ে অনর্গল অশ্রু ঝরতে লাগল। ছেলেটা এবং তার মায়ের জন্য কিছু একটা করা দরকার। কিন্তু ছেলেটা আমার কাছে এত সময় যা বলেছে_ তা যে সব সত্য, এমনটা তো নাও হতে পারে। কারণ আজ-কাল ঢাকা শহরে প্রতারকের অভাব নেই। সুখ দুঃখের কাহিনী শুনে হাজার হাজার টাকা আত্মসাৎ করে। তাই আমি সত্য যাচাই করার জন্য ছেলেটার কাছে জানতে চাইলাম_ ‘তোমরা এখন কোথায় থাকো?’
_ এই তো! একটু সামনে’ই। হেঁটে যেতে মিনিট পাঁচ ছয় লাগে।
_ তোমাদের বাসায় কি এখন আমার নিয়ে যেতে পারবে?
_ ঠিক আছে, চলুন…
আমি ওর মায়ের জন্য এক প্যাকেট বিরিয়ানি নিয়ে, ওর সাথে ওদের বাড়িতে গেলাম। কিন্তু সেখানে আর ইট, বালি, সিমেন্ট অথবা বাঁশ, কাঠের কোন ঘর খুঁজে পেলাম না। ফুটপাতের পাশে কয়েকটা প্লাস্টিকের বস্তা দিয়ে একটা ঘর বানানো। ভিতরে সারা দিনের বৃষ্টির পানিতে একাকার হয়ে আছে। ভদ্র মহিলা পানির মধ্যে’ই বসে আছে। তার দুই পা শিকল দিয়ে বাধা। এর কারণ জিজ্ঞেস করলে ছেলেটি বলল_ ‘ইদানিং আম্মু মানসিক এবং শারীরিক ভাবে অনেক অসুস্থ। শিকল দিয়ে বেঁধে না রাখলে বাহিরে চলে যায়। ১৪/১৫ বছর বয়স, এমন কোন মেয়েকে দেখলে, নিজের মেয়ে ভেবে জড়িয়ে ধরে। এতে তারা ক্ষিপ্ত হয়। পাগল বলে মারধর করে। আবার কেউ কেউ ছেলে ধরা বলে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। আমি ছেলেটার কথাগুলো শুনে আর স্থীর থাকতে পারলাম না। প্লাস্টিকের বস্তার প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে এলাম।
রাত বাজে এখন প্রায় দুইটা। রাস্তাগুলো প্রায় জনমানবহীন। আমি রাস্তার পাশ দিয়ে হাটতেছি আর ভাবতেছি, ‘হায়! আজও যদি এ পৃথিবীতে হরযত উমর বেঁচে থাকত। তাহলে নিশ্চয়ই আবিরের পরিবার ন্যায় বিচার পেত। ঘর হারা হয়ে বৃষ্টির পানিতে ভিজে, না খেয়ে রাত কাটাতে হতো না। হযরত উমর’ই তাদের খোঁজ-খবর নিতে। হে পৃথিবী! তোমার বুকে আবার একটা উমরের খুব প্রয়োজন।’
কতটা কাঁদার পরে ভেসে যাবে নদী
বাতাসের আলোড়ন রেখে যাবে প্রাণ,
কতটা চলার পরে শেষ হবে চলা
যেখানে সুকুনে রবে আমার পরাণ।