কিছু মানুষ যেন সময়ের আগেই দৌড়ে চলে— পড়াশোনা, কাজ, জীবন সব কিছুতেই এক অদ্ভুত গতিতে এগিয়ে যায়! এমনকি যখন আমরা জীবন নিয়ে ধুমসে হাঁপাচ্ছি, তারা তখনও হাসতে হাসতে মাইলের পর মাইল দুর্বার গতিতে পেরিয়ে যাচ্ছে! তাদের দেখে মনে হয়, যেন কোনো গোপন মন্ত্র জানা আছে অথবা কোনো অদৃশ্য জাদুর কাঠি তাদের হাতের মুঠোয়। তখন আমাদের মাথায় বরাবরই একটি প্রশ্ন ঘুরতে থাকে—
“কীভাবে? কীভাবে এরা এত অনায়াসে এগিয়ে যায়? কীভাবে এই মানুষগুলো এত সহজে সব সামলে ফেলে?
সহপাঠী হোক, সহকর্মী হোক, কিংবা খুব কাছের কোনো বন্ধু— যখন দেখি তারা কাজের পাহাড়, পড়ার ধাক্কা, জীবনের লাটিমের মতো ঘুরপাক সামলে অনায়াসে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে, তখন মনে হয়— বুঝি ওরা অন্য কোনো গ্রহের বাসিন্দা। অথবা কোন দূর নক্ষত্রপুঞ্জ থেকে পাঠানো বিশেষ মিশনের এলিয়েন! কিংবা, কোন গোপন জাদুকরী স্কুল থেকে পাস করা ছদ্মবেশী উইজার্ড, যা হ্যারি পটারের চেয়েও নিখুঁত! অথবা… গভীর রাতে পুরনো কোনো ধূসর শহরে ঘুরে ঘুরে তারা পেয়েছে বিখ্যাত সেই কাল্পনিক আলাদিনের চেরাগ! যা তাদের সামান্য থেকে ‘সুপারহিউম্যান’ করে গড়ে তুলেছে। বাস্তবে কি তাই? না, বাস্তবে তা নয়।
না আছে তাদের হাতে সেই অলৌকিক শক্তি, আর না তারা shortcuts-এর কারিগর। তাহলে আসল রহস্য? হ্যাঁ, আসল রহস্য লুকিয়ে আছে তাদের প্রতিদিনের ছোট ছোট অভ্যাসে। যে অভ্যাসগুলো অতি সাধারণ, অথচ সময়ের সাথে সাথে তাদের তৈরি করে সুপারহিউম্যান, যারা নিজেদের জীবনকে চিত্রশিল্পী বা পেইন্টারের মতো গড়ে তোলে।
তাহলে চলুন, আমরা জেনে নেই, কিভাবে ছোট ছোট বীজ বপন করে তারা তৈরি করে বিশাল মহীরুহ।
১. ছোট উন্নতির দিকে মনোযোগ
“Rome wasn’t built in a day.” একদিনেই কোনো চূড়ান্ত ফল আসে না। সুপারহিউম্যান মানুষেরা জানে, ছোট ছোট অগ্রগতি নিয়মিত হলেই বড় সাফল্যের জন্ম হয়। তারা প্রতিদিন একটু একটু করে উন্নতি করে— আজ এক ধাপ, আগামীকাল দু’ধাপ। সময়ের সঙ্গে এই ছোট পদক্ষেপগুলো মিলেমিশে বিশাল রূপ ধারণ করে।
আপনি কি জানেন, বৃষ্টি কিভাবে হয়? প্রথমে আকাশে অগণিত ছোট ছোট জলকণার জন্ম হয়। এই ক্ষুদ্র কণাগুলো ধীরে ধীরে একত্রিত হয়ে বড়ো জলবিন্দু তৈরি করে। যখন সেই জলবিন্দুগুলোর ওজন মেঘের ভেতরে সামলানোর ক্ষমতার বাইরে চলে যায়, তখনই তারা বৃষ্টির ফোঁটায় রূপ নিয়ে মাটিতে ঝরে পড়ে। আর এই প্রতিটি ছোট কণা; গড়ে তোলে বিশাল এক প্রাকৃতিক ঘটনা। James Clear বলেছিলেন, “You do not rise to the level of your goals. You fall to the level of your systems.” অর্থাৎ বড় স্বপ্ন নয়, বরং ছোট ছোট নিয়মিত কাজের ধারা—এই সিস্টেমই আপনাকে গন্তব্যে পৌঁছে দেবে।
- তুমি আজ যদি ১% উন্নতি করো, বছরে ৩৭ গুণ এগিয়ে যাবে! (Atomic Habits)
২. সময়মতো বিরতি নেওয়া
“Rest is not idleness.” (–John Lubbock) বিরতি মানেই অলসতা নয়; বরং এটা হলো কাজের সেরা অংশগুলোর সূচনাপর্ব। আমাদের মধ্যে কিছু মানুষ এমন আছে, যারা কোন কাজ শুরু করার পর থেকে, যতক্ষণ পর্যন্ত না উক্ত কাজটা শেষ হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত তারা কাজ করতেই থাকে করতেই থাকে। এর ফলে কি হয়? তারা মানসিক এবং শারীরিকভাবে ভেঙে পড়ে, সৃজনশীলতা হারিয়ে ফেলে। আপনি কি জানেন? আজকের কর্মব্যস্ত দুনিয়ায়, সফল মানুষদের গোপন অস্ত্রের একটি হলো— কৌশলী বিরতি নেওয়ার অভ্যাস।
মনোবিজ্ঞানী Roy F. Baumeister তার গবেষণায় দেখিয়েছেন, দিনের বেলা অসংখ্য কাজ এবং সিদ্ধান্ত নিতে নিতে আমাদের মানসিক শক্তি ক্ষয় হতে থাকে। এটা ঠিক মোবাইলের ব্যাটারির মত। সারাদিন একটানা কাজ এবং সিদ্ধান্ত নিতে থাকলে, আমাদের কাজের মান ও ফোকাস দুটোই কমে যায়। তাই সফল মানুষরা— শরীর ক্লান্ত হবার আগেই মস্তিষ্ককে রিচার্জ করে নেয়।
এক ইতালিয়ান বিশেষজ্ঞ ফ্রান্সেসকো সিরিলো ১৯৮০ সালের দিকে একটা মজার টেকনিক বের করেছিলেন। উনি বলেন,
১. কাজ বেছে নাও
🔹 আগে থেকে ঠিক করো তুমি কোন কাজ করবে।
২. ২৫ মিনিট পুরো মনোযোগ
🔹 টাইমার সেট করো— ২৫ মিনিট কাজ করো একটানা, কোনো বাধা ছাড়া! (না মোবাইল, না চ্যাট!)
৩. ছোট বিরতি (৫ মিনিট)
🔹 একটু হাঁটো, পানি খাও, চোখ বন্ধ করে বিশ্রাম নাও।
৪. ৪টা Pomodoro শেষে বড় বিরতি
🔹 চারবার ২৫ মিনিট (২৫x৪=১০০) কাজ শেষ হলে ১৫-৩০ মিনিটের একটা লম্বা বিরতি নাও।
বিজ্ঞান বলে, এই ক্ষণিকের বিরতিগুলো শুধুই আরাম বা শান্তির জন্য নয়— এগুলো মস্তিষ্কের নতুন মাএায় চার্জ (new neural pathways) তৈরিতে সহায়তা করে। ফলে ক্রিয়েটিভ চিন্তা ও সমস্যার সমাধান করার দক্ষতা বহুগুণ বেড়ে যায়। একটা দারুণ কথা আছে: “Resting is not quitting; it’s pausing to sharpen the sword.” ঠিক যেমন কাঠুরে যদি তার কুড়াল বারবার ধার না দেয়, তাহলে তার কাজ একসময় ধারের অভাবে ধীর গতি হয়ে যায়— তেমনি বিরতি ছাড়া কাজ করলে, কাজের উন্নতির গতি অদৃশ্য হয়ে যায়। বিরতিই হলো ধার দেওয়া, শক্তি সঞ্চয় করা, আবার নতুন করে জয় করার প্রস্তুতি।
৩. অন্যের মতামত গ্রহণ
একবার ভাবুন তো — একটা নদী যদি বলে, “আমার কাছে যথেষ্ট পানি আছে, আর দরকার নেই,” তাহলে সে কখনো মহাসাগরে পৌঁছাতে পারবে? ঠিক তেমনি, যারা সত্যিকারে বড়, তারা কখনোই শেখার দরজা বন্ধ রাখে না।
কখনো কি খেয়াল করেছেন? আমাদের সমাজে কিছু মানুষ আছে, তারা যতটুকু না কলম উঠাইতে পারে, তার থেকেও বেশি অহংকার করে— তাদের এই ধারণা একেবারে ভুল! আসলেই যারা সত্যিকারের সুপারহিউম্যান, তারা নিজেদের সবজান্তা ভাবেন না। বরং, তারা মন খুলে শোনেন। চাকরিজীবী হোক বা শিক্ষার্থী— যারা নিজের উন্নতির পথে সত্যিকার দৌড় দেন, তারা নির্দ্বিধায় অন্যের কাছে যান, আর খুব সাধারণভাবে জিজ্ঞেস করেন:
“আমি কীভাবে আরও ভালো করতে পারি?”
“কোন দিকটা ঠিক করলেই আমি আরও শক্তিশালী হব?”
তাঁরা জানেন, গঠনমূলক সমালোচনা (Constructive Feedback) আসলে একেকটা সোনার খনি। প্রতিটি মতামত হলো একেকটা লুকানো মানচিত্র, যা আপবার গোপন শক্তির খোঁজ দিবে! স্টিভ জবস নিজেও বলেছিলেন— “It doesn’t make sense to hire smart people and tell them what to do; we hire smart people so they can tell us what to do.” অর্থাৎ, যারা সত্যিকারের মেধাবী, তারা কখনো ভয় পায় না শেখার জন্য নিচু হতে। তারা জানে, অন্যের অভিজ্ঞতা মানে নতুন আকাশের চাবি হাতে পাওয়া।
“বুদ্ধিমান মানুষ প্রশ্ন করে, বোকা মানুষ সব জানে ভেবে বসে থাকে।”
৪. কৃতজ্ঞতা প্রকাশ
চলুন একটু কল্পনা করি— ভোরের আলো ঠিক তখনই জানালার ছিদ্রপথে ঢুকছে, যখন আপনি চোখ খুললেন। বাতাসে ভেসে আসছে এক অদ্ভুত নরম ঘ্রাণ— নতুন ভেজা মাটির গন্ধের মতো, বা অনেকদিনের পুরনো কোনো প্রিয় স্মৃতির মতো। আপনার বুকের ভেতর হালকা একটা নাড়া লাগলো। কারণ কোথাও না কোথাও আপনি টের পাচ্ছেন— এই মুহূর্তটা কেবল আপনার জন্যই তৈরি হয়েছে। এমন নরম রোদ, এমন নিস্তব্ধতা, এমন সুযোগ… এগুলো তো প্রতিদিন আসে না, সবদিন আপনার অপেক্ষায় থাকে না। এই ছোট্ট উপলব্ধিতে যদি আপনি আস্তে করে নিজেকে বলেন— “ধন্যবাদ, এই ছোট্ট সুন্দর মুহূর্তের জন্য,”
বিশ্বাস করেন, এই সামান্য অনুভূতিটাই বদলে দিবে আপনার পুরো দিন। এটাই হলো কৃতজ্ঞতার আসল জাদু।
আমি আপনি কিছু অর্জন করার পরেও মনের মত না হলে বলি, Life is futile. আর এই ধরনের মন মানসিকতা এবং চিন্তাভাবনা করার ফলে আমাদের মস্তিষ্কের মধ্যে এক ধরনের Bad effect পড়ে। আর তখনই আমরা Depression হয়ে যায় এবং যার প্রভাব পরবর্তী কোনো কাজের উপর পড়ে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, ‘প্রতিদিন কৃতজ্ঞতার কথা লিখে রাখলে মানুষ আরও বেশি সুখী, কম টেনশনে ভোগে এবং ভালো ঘুমায়।’ আরেকটা মজার কি জানেন?
কৃতজ্ঞতা বাড়াতে পারে দীর্ঘমেয়াদে সফলতার সম্ভাবনাও! সাধারণ মানুষ যেখানে হতাশ হয়ে ছেড়ে দেয়, কৃতজ্ঞ মানুষ ধৈর্যের সঙ্গে এগিয়ে চলে। কারণ তারা জানে, ছোট অর্জন হোক বা বিশাল সাফল্য— কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতেই হবে। কারণ, কৃতজ্ঞতা হলো এমন এক যাদুকরী চশমা, যেটা দিয়ে আমরা জীবনকে আরও রঙিন দেখতে পারি। একটা সুন্দর কথা আছে:
“Gratitude turns what we have into enough.” (কৃতজ্ঞতা আমাদের যা আছে, তাকেই যথেষ্ট করে তোলে।)
বুঝতেই পারছেন, যখন আমরা মনে করি, আমাদের যা আছে তাতেই আনন্দ, তখন জীবনের ছন্দটাই বদলে যায়। ছোটো এক কাপ চা, বন্ধুদের একটা হাসি, একটা মধুর বিকেল— সবকিছু তখন মনে হয় স্বর্গের টুকরো।
৫. ভবিষ্যতের সাফল্য নিজের চোখে দেখতে শেখা
চোখ বন্ধ করুন একবার। ভাবুন, আপনি ঠিক সেই জায়গায় পৌঁছে গেছেন, যেখানটার জন্য এতদিন স্বপ্ন দেখেছেন। আপনি সফল, আত্মবিশ্বাসী, উজ্জ্বল— নিজের চাওয়া সবকিছু অর্জন করেছেন। চারিদিকে লোকের আপনাকে বাহ বাহ দিতেছে, আপনার সফলতার জয় গান গাইতেছে। এই অনুভূতিটা কেমন লাগছে? চমৎকার, তাই না?
সফল মানুষরা জানেন, সাফল্য আগে মনে জন্মে, পরে বাস্তবে ধরা দেয়। তাঁরা প্রতিদিন নিজেদের ভবিষ্যতের ছবি চোখের সামনে আঁকেন। নিজেদের সফল, শক্তিশালী, এবং শান্ত মনে করে অনুভব করেন। আর ঠিক এই অনুভব থেকেই জন্ম নেয় তাদের বাস্তব পরিকল্পনা, কঠিন পরিশ্রম আর দৃঢ় সংকল্প।
আপনি যদি আজ থেকেই সেই জীবনের স্বাদ নিতে শুরু করেন, যেটা আপনি ভবিষ্যতে চান, তাহলে আপনার মন আর শরীর, দুটোই আপনাকে সেই দিকেই ঠেলে নিয়ে যাবে।
“Dream it. Feel it. Work for it.” (স্বপ্ন দেখুন, অনুভব করুন, তারপর তার জন্য কাজ করুন।) নিজেকে ছোট করে দেখবেন না। নিজেকে বড় ভাবুন, বড় অনুভব করুন— তাহলেই একদিন আপনি বড় হয়ে উঠবেন। কারণ, মনে রাখবেন, “আপনার দৃষ্টিই আপনার ভবিষ্যত গড়ে দেয়।”
৬. সাফল্য উদযাপন
“Work hard in silence, let success make the noise” — কথাটা নিঃসন্দেহে দারুণ, কিন্তু নিজের ছোট-বড় সাফল্য নিজে উদযাপন করাও কম জরুরি নয়। সুপারহিউম্যান মানুষরা এটা খুব ভালোভাবেই পালন করেন। তাঁরা শুধু সামনে দৌড়ান না, মাঝেমধ্যে থেমে নিজের অগ্রগতি দেখে নেন, নিজেকে বাহবা দেন, একটু হাঁফ ছেড়ে হাসেন।
আপনারও উচিত, ছোট একটা মাইলস্টোন ছোঁয়ার পর নিজের জন্য একটা পুরস্কার রাখা। অর্থাৎ প্রত্যেকটা কাজ শুরুর আগেই যে পরিকল্পনা করবেন, সে পরিকল্পনার মধ্যে এটাও রাখবেন যে, আমি আমার এই কাজটা সমাপ্ত করার পর, আমি আমার নিজেকে এই উপহারটা দেব। যেমন, প্রিয় কোনো কফি শপে এক কাপ কফি বা একটা সিনেমা দেখা, অথবা নিজেকে একটা মিনি-ভ্রমণ উপহার দেওয়া।
এই ছোট ছোট উদযাপন আপনার মনোবল অনেকখানি বাড়িয়ে দেবে। আর মনোবল বাড়লে, পরবর্তী লক্ষ্য ছুঁতে আপনার পথ আরও মসৃণ হবে। “Celebrate every tiny victory. Success loves to be noticed.” (প্রতিটা ছোট জয় উদযাপন করুন। সাফল্যও চায়, আপনি তাকে খেয়াল করুন।) তাই মনে রাখুন, নিজের প্রতিটি অগ্রগতি, প্রতিটি ছোট সাফল্যকে সম্মান এবং গুরুত্ব দিন। কারণ, এভাবেই গড়ে ওঠে বড় ইতিহাস!
৭. স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজে যুক্ত থাকা
আপনার জীবন থেকে কিছু সময় রাখুন অন্যদের জন্য। পেশার বাইরেও জীবনের একটা অর্থ থাকা খুবই জরুরি, এবং এটাই সুপারহিউম্যান মানুষের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। তারা জানে, শুধুমাত্র নিজের জন্য কাজ করা নয়, সমাজের জন্য কিছু করা জীবনকে আরও অর্থবহ করে তোলে।
সুপারহিউম্যান মানুষরা নিজেদের সময়ের একটা অংশ নিঃস্বার্থ কাজে ব্যয় করে— কখনো অসহায় মানুষের সাহায্যে, কখনো পরিবেশ রক্ষায়, কখনো বা অন্যদের জন্য শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সুবিধা বাড়ানোর কাজ করে। এই অভ্যাস তাদের মনে সহমর্মিতা, ধৈর্য আর মানসিক প্রশান্তি এনে দেয়।
যেমন মহাত্মা গান্ধী বলেছেন: “The best way to find yourself is to lose yourself in the service of others.”
যখন আপনি অন্যের জন্য কিছু করবেন, তখন দেখবেন তাদের জীবনটা কেমন যেন তাদের নিজেদের চারপাশেই ঘুরছে। অতঃপর যখন আপনি তার মুখে হাসি ফোটান, একটু সাহায্য করেন—তখন? তখন আপনি শুধু নিজের অনুভূতিটা বদলে ফেলেন না, বরং আপনার মনের দরজাগুলো খুলে দেন। আর ওই যে… ওইখানেই আসল সুখটা লুকিয়ে থাকে।
আপনি যদি বিল গেটসের জীবনের দিকে দেখেন, তিনি কিন্তু নিজের সফলতার একটা বড় অংশ স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজেই ব্যয় করছেন। গেটস ফাউন্ডেশন গঠন করে, তিনি বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোর স্বাস্থ্য ও শিক্ষা ব্যবস্থা উন্নত করার জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। তিনি তার শত শত কোটি ডলার দান করেছেন এবং আজও করেন—এটা তার জীবনের এক বড় লক্ষ্য, যা শুধুমাত্র ব্যক্তিগত লাভের জন্য নয়, মানুষের কল্যাণের জন্য। স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজের মাধ্যমে আপনি শুধু নিজের জীবনের লক্ষ্য খুঁজে পাবেন না, বরং পৃথিবীটাকেও কিছুটা সুন্দর করে তুলতে পারবেন।
৮. মননশীলতার অনুশীলন
আপনি কখনও কি অনুভব করেছেন, দিনের শেষে মাথার ভিতর হাজারো চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে? মনে হচ্ছে, একটা বিশাল সাগরের ঢেউয়ের মতো চিন্তাগুলো একটার পর একটা আসছে—প্রকৃতির কাছে কিছু সময় পাওয়া যেন অসম্ভব! সাগরের মতোই আপনার মনের মাঝে অশান্তি থাকে, কিছু একটা প্রস্থানের পথ খুঁজে না পেয়ে।
এমন সময়, আপনি যদি নিজেকে একটু থামিয়ে শুধু এক মিনিটের জন্য গভীর শ্বাস নেন, যেমন সাগরের ঢেউ একে একে শান্ত হয়, তেমনি আপনার মনও একসময় শান্ত হয়ে যাবে। ধীরে ধীরে, আপনি বুঝতে পারবেন যে আপনার মনের মধ্যে এখন একটি শান্ত বাগান ফুটে উঠেছে—এখানে যেন নতুন, সুন্দর ফুলগুলি গাছের মতো ফুটতে শুরু করেছে। আর এই শান্ত বাগানটাই তো, আপনার সাফল্যের চাবিকাঠি!
সুপারহিউম্যানরা জানেন, মনের শান্তি একটা প্রশস্ত মাঠের মতো যেখানে চিন্তাগুলো প্রফুল্লিত ফুলের মতো ফুটতে পারে। তারা ধ্যান, শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম কিংবা mindfulness চর্চাকে নিজের রুটিনে অন্তর্ভুক্ত করে। এর ফলে, তাদের মনের মাঝে কোনো খারাপ বা অশান্তি ভাবনা প্রবাহিত হতে পারে না। আপনি যদি মনকে শান্ত করতে পারেন, তাহলে যে কোনো সমস্যা, সাগরের ঢেউয়ের মতো তুচ্ছ হয়ে যাবে।
এটাই মননশীলতা—মনে ফুল ফুটিয়ে দেওয়া, শান্তির মাঝে নিজেকে খুঁজে পাওয়া। এই প্রক্রিয়াটা শুধু একটানা ধ্যান নয়, এটা আসলে আপনার মনের গভীরে নিজেকে শুদ্ধ এবং সুস্থ রাখতে পারার কৌশল। Harvard Medical School এর গবেষণায়ও বলা হয়েছে, mindfulness নিয়মিত চর্চা করলে আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারা, সমস্যার সমাধান দ্রুত করা—এসব ক্ষেত্রেও মনকে কার্যকরভাবে ব্যবহার করা যায়।
অতএব, আপনি যদি সত্যিই চান আপনার জীবনে শান্তি এবং সাফল্য আনতে, তাহলে প্রতিদিন অন্তত পাঁচ মিনিট সময় নিয়ে মনকে প্রশান্ত করুন। মনে করুন, আপনার মনের প্রতিটি ফুল একে একে ফুটতে শুরু করছে, আর এই মনের শান্তিই আপনাকে এনে দেবে জীবনের সেরা সিদ্ধান্ত।
৯. নিজের জন্য লেখা
কখনো কি মনে হয় আপনার মাথার মধ্যে হাজারটা কথা ঘুরতেছে? মানে, সকাল থেকে রাত—কী করবো, কী বলবো, কে কি বললো—এইসব নানারকম চিন্তা একটা বিশ্রী ভিড় বানায়? আমরা সবাই আসলে এর ভেতরেই থাকি। মাথার ভেতর যেন সারাদিন একটা বাজার বসে আছে! তবে সুপারহিউম্যান মানুষরা কিন্তু এক জাদু জানে। ওরা এই চিন্তাগুলোকে মাথায় জমিয়ে রাখে না, ওরা খাতায় জমিয়ে রাখে। হ্যাঁ, ঠিক শুনছেন, তারা খাতায় জমিয়ে রাখে।
ভাবেন তো, মাথার ভেতর যদি হাজারটা কথা থাকে, আর আপনি যদি এক এক করে কাগজে নামিয়ে ফেলেন, তাহলে মাথার ভেতরটা একদম ফাঁকা-ফাঁকা শান্তি শান্তি লাগবে না? যেমন একটা বিশাল ধোঁয়ায় ভর্তি ঘর যদি জানালা খুলে বাতাস ঢুকিয়ে পরিষ্কার করে দেন!
এটাকেই বলে জার্নালিং। মানে, ডায়েরি লেখার মতো, কিন্তু শুধুমাত্র কাহিনি লিখার জন্য না— বরং আপনি যা অনুভব করেন, যা ভাবেন, যা চান—সব নিজের সাথে আলাপ করে লিখে রাখার জন্য। ভাবেন, একটা পুকুর আছে, যেখানে অনেক ময়লা ভাসতেছে। আপনি যদি সেই পুকুরে নিয়ম করে পানি ঢালেন, একসময় পুকুরের পানি একদম পরিষ্কার হয়ে যাবে, তাই না? লেখাও ঠিক তেমন—মনের পুকুর পরিষ্কার করে।
আর মজার ব্যাপার কী জানেন? কখনো যদি মন খারাপ হয়, হতাশ লাগে, মনে হয় কিছুই ঠিক হচ্ছে না— তখন নিজের পুরনো লেখা পড়েন। দেখবেন, আগে কত বড় বড় সমস্যা পার করে এসেছেন! নিজেই অবাক হবেন, “আরে! আমি এত কিছু পারছি?” আর মনোবিদরাও বলেন—লেখার অভ্যাস থাকলে মন শান্ত হয়, মাথা পরিষ্কার থাকে, সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ হয়। এইজন্যই বড় বড় সফল মানুষরা রোজ একটু সময় বের করে নিজেদের জন্য লেখে।
১০. সৃজনশীলতার চর্চা
কাজের চাপে বা পড়ালেখার ভিড়ে কখনো কি আপনার মনে হইছে, জীবনটা একটু কালো-সাদা হয়ে গেছে? একটু যেন ফ্যাকাসে ফ্যাকাসে? মনটা যেন একঘেয়ে মাঠের মতো শুকনো? সুপারহিউম্যান মানুষরা কিন্তু এই ফাঁক বুঝে, নিজেদের মনের মাঠে রঙের ফুল ফোটায়। ওরা শুধু কাজের খাঁচায় আটকে থাকে না, ওরা নিজের জন্য একটু সময় বের করে নেয়— কখনো গান গায়, কখনো ছবি আঁকে, কখনো রান্নাঘরে নতুন রেসিপি বানায়।
মনটা যেন ছোট্ট একটা বাচ্চা, যাকে খেলতে দিলে সে খুশিতে লাফায়—ঠিক তেমনি! ভাবুন তো, যদি প্রতিদিন শুধু একই রুটিনে বাঁচেন, মনের পুকুরের পানি তো একসময় দাগ ধরা শুরু করবে, তাই না? কিন্তু যখন আপনি হাতের তুলিতে ছবি আঁকেন, বা গিটারের তারে একটা সুর তোলেন, তখন সেই পানিতে বাতাস ঢুকে— ঝিরঝিরে হাওয়ার মতো নতুন চিন্তা আসে, তাজা আইডিয়া ভেসে ওঠে!
সারাদিন অফিসে কাজ করার পর রাতের বেলা যখন আপনার শখের গিটারটা হাতে নিবেন, মনে হবে, সব ক্লান্তি কেউ যেন এক নিমিষেই মুছে দিল। তখন আপনার ভিতরে একটা নতুন আমি জেগে উঠবে। আপনার নিজের ভেতরকার সেই ছোট্ট আনন্দের বাতিঘরটা আলোকিত হয়ে উঠবে ।
সৃজনশীল কাজ শুধু মন ভালো রাখে না, আপনার বুদ্ধিকেও ধারালো করে। নতুন সমাধান খুঁজে পাওয়ার, নতুন রাস্তায় হাঁটার সাহস এনে দেয়। আপনার চিন্তার জগতটা যদি একটা নৌকা হয়, তাহলে এইসব সৃজনশীলতা হাওয়ার মত ঢুকে এসে সেই নৌকাটাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে, নতুন নতুন বন্দরের দিকে।
শেষ কথাঃ
সাফল্য কখনোই একটি গন্তব্য নয়—এটা এক অসীম যাত্রা। আর এই যাত্রার রাস্তাটি মসৃণ ও সুন্দর হতে পারে, যদি আপনি কিছু শক্তিশালী অভ্যাসের হাত ধরে এগিয়ে চলেন।
আজ যদি আপনি একটু একটু করে এই অভ্যাসগুলো নিজের জীবনে অন্তর্ভুক্ত করতে শুরু করেন, তবে আপনি দেখতে পাবেন, আগামী দিনের আপনি এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ও শক্তি নিয়ে আরো দীপ্ত, আরো পরিপূর্ণ, এবং আরও অবাক করা হয়ে উঠবেন। সাফল্যের পথ কখনো সরল নয়, তবে যদি আপনি এক একটি অভ্যাস গড়ে তোলেন, প্রতিটি পদক্ষেপেই আপনি নতুন একটি সাফল্যের দিকে এগিয়ে যাবেন।
তাহলে, আপনি কি প্রস্তুত, নিজের কৃতিত্বের গল্পটি নিজেই লেখার জন্য? আপনার প্রতিটি ছোট পদক্ষেপ আজই শুরু হোক, কারণ—
“বীজ বপন করো আজই; মহীরুহ হওয়ার দিন আর বেশি দূরে নয়।”
এক নজরেঃ__
অভ্যাস | বর্ণনা |
১. ছোট ছোট উন্নতির দিকে মনোযোগ | প্রতিদিন ছোট ছোট পদক্ষেপে উন্নতি করুন—এটাই সাফল্যের চাবিকাঠি। |
২. বিরতি নেওয়ার শিল্প | কর্মের মাঝে ক্ষণিক বিরতি নিন, যাতে মন ও শরীর সতেজ থাকে। |
৩. অন্যের মতামত গ্রহণের সাহস | নিজের উন্নতির জন্য অন্যদের কাছ থেকে মতামত নিয়ে শেখার মনোভাব গড়ে তুলুন। |
৪. কৃতজ্ঞতা প্রকাশ | জীবনের প্রতিটি সুযোগের জন্য কৃতজ্ঞ থাকুন—এটি আপনাকে ইতিবাচক রাখবে। |
৫.ভবিষ্যতের সাফল্য নিজের চোখে দেখতে শেখা | নিজের সফল ভবিষ্যত কল্পনা করুন এবং সেই অনুযায়ী কাজ শুরু করুন। |
৬. সাফল্য উদযাপন | আপনার ছোট ছোট সাফল্য উদযাপন করুন, এটি আরও বৃহত্তর সাফল্যের পথ তৈরি করবে। |
৭. স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজে যুক্ত থাকা | পেশাগত কাজের বাইরে মানুষের জন্য কিছু করুন, এটি আপনাকে পূর্ণতা দেবে। |
৮. মননশীলতার অনুশীলন | ধ্যান এবং mindfulness চর্চা করে নিজের মনকে শান্ত এবং পরিষ্কার রাখুন। |
৯. নিজের জন্য লেখা | নিজের অনুভূতি, চিন্তা, এবং চ্যালেঞ্জ লিখে রাখুন—এটি আপনাকে আত্মবিশ্বাসী করবে। |
১০. সৃজনশীলতার চর্চা | কাজের বাইরের সৃজনশীল কাজে সময় দিন, এটি আপনার চিন্তাভাবনাকে উদ্ভাবনী করবে। |
এখন কি আপনি প্রস্তুত, আপনার কর্তৃত্বের গল্প লিখতে?
সূত্র: বই, উইকিপিডিয়া এবং ইন্টারনেট