দশ বছর আগের কথা। তখন স্কুলে পড়ি। জীবনের প্রতিটি দিন ছিল নির্ভার আর আনন্দময়। আমাদের ক্লাসে রাফা নামে একটা মেয়ে ছিল, যে ছিল সবচেয়ে সুন্দরী। তার রূপ ছিল এমন যে, এক নজরে যে কেউ মুগ্ধ হয়ে যেত। রাফার হাসি যেন চারপাশে আলো ছড়িয়ে দিত, আর তার চোখে-মুখে ছিল এক অনির্বচনীয় মায়া। ক্লাসের প্রায় সব ছেলেই তাকে পছন্দ করত, তাকে নিয়ে রোমান্টিক স্বপ্ন দেখত, আর মেয়েরা তার মতো হতে চাইত। রাফার চলাফেরা, কথা বলার ধরন___ সব কিছুতেই ছিল এক ধরনের মাধুর্য, যা সবাইকে আকৃষ্ট করত।
কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় সব কিছু বদলে যায়। আজ সেই রাফা দুই সন্তানের মা। জীবনের দায়িত্বের ভার আর পরিবর্তনের ঢেউ তার রূপের উপর নিজের ছাপ রেখে গেছে। যে রূপ একসময় সবাইকে মুগ্ধ করত, আজ তা সময়ের সাথে মলিন হয়ে গেছে। সন্তানের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে, নিজের জন্য সময় বের করা তার পক্ষে আর সম্ভব হয় না। অথচ একসময় রাফা ছিল সবার দৃষ্টি আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু, যার সৌন্দর্যে ক্লাসের চারপাশ আলোকিত হতো। আজকের রাফার জীবনে সেই আলো নিভে গেছে এবং সময়ের হাত ধরে তার জীবনের গল্প নতুন পথে চলতে শুরু করেছে।
মনে পড়ে আমার ক্লাসমেট ফারহানের কথা। সেই ছেলেটি, যে সব পরীক্ষায় নকল করে পাস করত। ক্লাসের সবাই তাকে অবহেলা করত, কেউ ভাবতেও পারেনি যে সে জীবনে কিছু করবে। কিন্তু সময়ের পালাবদলে, ফারহান নিজেকে প্রমাণ করেছে। আজ সে একজন সফল বিসিএস ক্যাডার, নিজের জীবনে স্থিতিশীল অবস্থান তৈরি করেছে। যারা একসময় তাকে নিয়ে হাসাহাসি করত, আজ তারা তার দিকে তাকিয়ে থাকে শ্রদ্ধার চোখে।
আরেক ক্লাসমেট তাওহিদ। তার গল্পটি আবার অন্যরকম। তাওহিদ ছিল ক্লাসের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্র, যার উপর সবারই ছিল অনেক আশা। সবাই ভাবত___ তাওহিদ একদিন বড় কিছু করবে, তার নাম হবে, বাবা-মায়ের মুখ উজ্জ্বল করবে। কিন্তু জীবনের কঠিন বাস্তবতায় তার স্বপ্নগুলো একে একে ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। আজ তাওহিদ বেকার, জীবনের চাপে সে যেন এক রকম হারিয়ে গেছে। তার মেধা, পরিশ্রম__ সব কিছুই যেন সময়ের কাছে পরাজিত হয়েছে।
রেহানের কথাও মনে পড়ে? সেই ছেলেটি, যার একটা বাইক ছিল, আর সেটার জন্য সে ছিল ক্লাসের মেয়েদের চোখে হিরো। আর এই কারণেই অন্যের গার্লফ্রেন্ড ভাগিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা ছিলো তার। আচরণ ছিল দুঃসাহসী। সে কারো কথা শুনত না, তার চলাফেরা ছিল বেপরোয়া। কিন্তু সময়ের সাথে সব বদলে গেছে। আজ তার হবু বউ অন্য একজন প্রতিষ্ঠিত টাকাওয়ালার স্ত্রী। রেহানের সেই দুঃসাহস আর অহংকার সময়ের ধাক্কায় ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে।
রিয়াদ ছিল আমাদের ক্লাসের সবচেয়ে অহংকারী ছেলে। তার কথা-বার্তা, চাল-চলন___ সব কিছুতেই ছিল এক ধরনের অহমিকা। তার মধ্যে ছিল এক ধরনের নিজেকে নিয়ে অতিরিক্ত গর্ববোধ। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে তার সেই অহংকার আর নেই। আজ রিয়াদ ঋণের বোঝায় জর্জরিত, তার জীবনের সেই অতিরিক্ত গর্ববোধ আজ মাটির সাথে মিশে গেছে।
তাসিনের কথাও মনে পড়ে। ক্লাসের সেই সুদর্শন ছেলেটি, যার সৌন্দর্যে মেয়েরা প্রতিনিয়ত ক্রাশ খেত। কিন্তু তাসিনের এই বিষয় নিয়ে কোনো আগ্রহ ছিল না। সে সব সময় চুপচাপ থাকত, ক্লাসের শেষ বেঞ্চে বসে থাকতো এবং পড়াশোনায় মনোযোগী ছিল না। পরীক্ষায় তার খারাপ ফলাফলও হত। অনেকেই ভাবত যে তাসিন জীবনে কিছু করতে পারবে না এবং তার ভবিষ্যৎ অস্পষ্ট।
তবে সময়ের পরিক্রমায় তাসিন সবাইকে অবাক করে দিয়েছে। আজ, সে ডাক্তারি পড়া শেষ করে ফেলেছে এবং নিজের মেধার পরিচয় দিয়েছে। তাসিনের এ সাফল্য তার আগের সব ধারণাকে মিথ্যা প্রমাণ করেছে এবং প্রমাণ করেছে যে, সামর্থ্য ও ধৈর্যের মাধ্যমে যেকোনো বাধা অতিক্রম করা সম্ভব। তার জীবন এখন একটি অনুপ্রেরণার গল্প, যা প্রমাণ করে যে, প্রতিকূলতার মধ্যেও সাফল্য অর্জন করা সম্ভব।
আমাদের আরেক ক্লাসমেট ছিল আনিকা। তিনি ছিলেন সেই মেয়ে, যে সর্বদা ছেলেদের পেছনে ঘুরতেন এবং বারবার বয়ফ্রেন্ড বদলাতেন। আনিকা ছিল সবার প্রিয়, তার ব্যক্তিত্ব ছিল এমন যে অল্প সময়ের মধ্যে মানুষকে মুগ্ধ করতে পারতেন। তাঁর হাস্যোজ্জ্বলতা, চটপটে কথাবার্তা এবং স্বাভাবিক আচার-আচরণ তাকে সকলের কাছে জনপ্রিয় করে তুলেছিল।
কিন্তু সময়ের সঙ্গে আনিকার জীবনেও পরিবর্তন এসেছে। আজ, সেই আনিকা পাত্র পক্ষের কাছে বারবার রিজেক্ট হচ্ছেন। অতীতের সেই প্রাণবন্ত ও জনপ্রিয় আনিকার জীবন এখন একরকম একাকিত্বের মুখোমুখি। সময় যেন তার জীবনের আনন্দের মুহূর্তগুলো একে একে কেড়ে নিয়েছে। একসময় সবার প্রিয় আনিকা আজকের দিনে যেন জীবনের মঞ্চে একা দাঁড়িয়ে আছেন। সময়ের নির্মমতা তাকে যেন কঠোর শাস্তি দিচ্ছে, তার সুখের দিনগুলো ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে।
ক্লাসের সেরা বন্ধুত্বের জুটির কথাও ভুলতে পারি না। আমরা সবাই তাদের ‘কবুতরের জোড়া’ বলে ডাকতাম। তাদের বন্ধুত্বের গল্প ছিল ক্লাসের প্রতিদিনের আলোচনার বিষয়। সবাই তাদের সম্পর্ককে ঈর্ষা করত এবং তারা ছিল সবার চোখে মডেল কাপল। কিন্তু সময়ের নিষ্ঠুর পরীক্ষায় সেই বন্ধুত্ব টিকে থাকতে পারেনি। আজ তারা একজন আরেকজনের ব্লক লিস্টে, তাদের একসময়ের অটুট বন্ধন আজ ভেঙে গেছে।
নিপার কথাও বলা দরকার। ক্লাসের সেই মেয়ে, যে কারো কথা কখনো কর্ণপাত করত না। জীবন যাপন করত নিজের মত করে। অন্যের মতামতের কোন গুরুত্ব দিত না। একাধারে ছয় বছর প্রেম করে আজ নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে এক অপছন্দের মানুষের সাথে সংসার করছে। তার জীবনের রঙিন স্বপ্নগুলো আজ নিঃশেষ হয়ে গেছে, আর সময়ের সাথে তার জীবন হয়ে উঠেছে নিস্তেজ।
আরিফ ছিল আমাদের ক্লাসের সবচেয়ে প্রিয় এবং আড্ডাবাজ ছেলে। সে সব সময় বন্ধুত্বের আড্ডায় মাতিয়ে রাখত, আর তার হাসি-মজার কথা সবাইকে আনন্দে ভরিয়ে দিত। কিন্তু আজ!? সেই আরিফ একা। বন্ধু সার্কেলকে আনন্দে মাতিয়ে রাখা সেই ছেলেটি আজ বন্ধুহীনতায় ভুগছে। তার একসময়কার বন্ধুত্বের বাঁধন আজ ছিন্ন হয়ে গেছে, আর সময়ের খেলায় সে হেরে গেছে।
সময় এক অদ্ভুত শক্তি, যা আমাদের শিখিয়ে দেয় যে, কখন কার কপালে কী ঘটবে তা আগে থেকে জানা সম্ভব নয়। সাময়িক অর্থ, বিত্ত, রূপ-গুণের কারণে আমরা হয়তো মনে করি যে___ সময়কে নিজের মতো করে চালাতে পারব। কিন্তু সময় সবসময় ইচ্ছামত চলবে, এমন আশা করা ভুল।
সময় তার মতো করে শোধ নেয়, আর এই শোধ নেওয়ার প্রক্রিয়ায় সে আমাদের জীবনের সবকিছুই পাল্টে দেয়। আজকের সাফল্য কালকের ব্যর্থতায় পরিণত হতে পারে। আবার আজকের হতাশা আগামীদিনে হতে পারে জীবনের সবচেয়ে বড় সাফল্য। সময়ের সাথে আমাদের পথচলা তাই সবসময় চ্যালেঞ্জিং।
তবে সময়ের এই শোধ নেওয়ার খেলা থেকে আমাদের শেখার আছে অনেক কিছু। সময় আমাদের শিখিয়ে দেয় বিনয়, সহনশীলতা, এবং ধৈর্য। সময়ের সাথে আমাদের মানিয়ে নিতে হবে, কারণ সময়ের চলার গতি কখনোই থামে না। সময়ের এই অবিরাম ধারা আমাদের জীবনে নতুন নতুন অভিজ্ঞতা এনে দেয়, যা আমাদের মানুষ হিসেবে আরো পরিপূর্ণ করে তোলে।