রাত আনুমানিক তিনটা বাজে। ঢাকা কলেজের সামনে দিয়ে হাঁটতেছি। রাস্তার পাশে বিশাল বিশাল গাছ। শুকনো পাতা পড়ে আছে। পাতার গায়ে কদম ফেললে মড়মড় শব্দ করে। শুনতে আওয়াজ মন্দ নয়। ভালোই লাগে। মড়মড় শব্দে পা ফেলে এগিয়ে যাচ্ছি। মাঝে-মধ্যে রাতের বেলায় এভাবে বেরিয়ে পড়ি। বিশিষ্ট লেখক মুস্তাফিজ ইবনে আনির সাহেবের কোন এক গল্পে সম্ভবত এমন পড়েছিলাম_ ‘কিছু বাক্য কখনো পুরনো হয় না। জোসনা, চাঁদ, গোধূলি বিকেল, স্নিগ্ধপ্রভাত, মায়ের ভালোবাসা, এগুলো যেমন পুরনো হয় না, তেমনি কিছু বাক্য অধিক ব্যবহারেও কোন পুরোনো গন্ধ মিলে না। তার একটি “শখের তোলা আশি টাকা।” ইচ্ছা যখন শখে পরিণত হয়, তখন আর শখের হিসাব চলে না।’
আমার মাঝে-মধ্যে এমন শখ জাগে। গভীর রাতে শহরের মিটিমিটি আলো-আঁধারে রাস্তার পাশ দিয়ে হেটে চলা। দূর আকাশের চাঁদ আমার আমার সঙ্গ দেয়। সময়তে হিমেল হাওয়াও বয়। এক বোতল পানি ছাড়া সাথে আর কিছুই নেই না। এমনকি হাতের ঘড়িটাও। শখের রাতে মূল্যবান জিনিসগুলো সাথে রাখতে নেই। তাহলে শখের ব্যাঘাত ঘটে।
চারদিকে নিরব নিস্তব্ধ। কোন কোলাহল নেই। রাস্তার পাশে রাত কাটানো মানুষ গুলোও ঘুমিয়ে পড়েছে। দূর আকাশে দৃষ্টি ফেলে আনমনে হাটছি আর ভাবছি। কি ভাবছি নিজেও জানিনা! হাঁটতে হাঁটতে প্রায় দোয়েল চত্বরের কাছাকাছি চলে এসেছি। দূর থেকে লক্ষ্য করলাম, চত্বরে দুজন লোক বসে আছে। দুজনের মধ্যে পাঁচ-ছয় বছরের একটি বাচ্চা মেয়ে, আরেকজন বয়স্ক। আমি তাদের কাছে গিয়ে সালাম দিয়ে কেমন আছেন, এত রাতে এখানে বসে আছেন, কোন প্রোবলেম কি না জিজ্ঞেস করলাম। কিন্তু লোকটার থেকে কোন রেসপন্স পেলাম না। তার চেহারার দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম, সে আমার কথায় বিব্রতবোধ করছে। আর কোন কথা না বাড়িয়ে আমি আমার পথে পা’ বাড়ালাম। কিছুটা সামনে এগুতেই ‘বাবা’ বলে একটা চিৎকার কানে ভেসে এলো। দৌড়ে এলাম আবার চত্বরের দিকে। ভদ্রলোকটা দেখি রাস্তার মাঝে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে ছটফট করতেছে। ছিন্ন ভিন্ন হয়ে মাথা থেকে মগজ অনেকখানি বেরিয়ে গেছে। লোকটার ভয়াবহ এই অবস্থা দেখে আমি আতংকিত হয়ে গেলাম। পাশে বাচ্চা মেয়েটা হাউমাউ করে বাবা বাবা বলে চিৎকার করতেছে। বাচ্চাটাকে জিজ্ঞেস করলাম_ কীভাবে হলো এটা?
_আমি আর বাবা রাস্তা পার হতে গেলাম, আর তখনি বাবা একটা মাইক্রো গাড়ীর সাথে এক্সিডেন্ট করল।
_সেই গাড়ী কোন দিকে গেছে ?
_এই দিক দিয়ে গেছে।
মেয়েটার কান্না দেখে আমার খুব মায়া লাগলো। কিন্তু এই রাতে কি করব কিছু বুঝতে পারলাম না। আশ-পাশে কোন মানুষ তো দুরের কথা, কোন কাক পাখিও দেখতে পেলাম না। মিনিট দুয়েকের মাথায় একটি প্রাইভেটকার আসতে দেখলাম। থামার জন্য সিগন্যাল দিলাম। লোকটি গাড়ি থামালে আমি আহত লোকটিকে হাসপাতালে নেওয়ার জন্য অনুরোধ করলাম। ড্রাইভার ভদ্রলোক আমার কাছে জানতে চাইলো_ আহত লোকটি আমার কি হয় বা তার সাথে আমার সম্পর্ক কি?
_সে আমার কিছুই হয় না! আমি তাকে চিনিও না, জানিও না। আমি শুধুমাত্র একজন পথচারী। এই পথে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ একটি চিৎকারের আওয়াজ শুনে দৌড়ে এসে দেখি, লোকটা এখানে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে ছটফট করতেছে। রাস্তা পারাপার হওয়ার সময় নাকি একটা মাইক্রোবাস লোকটাকে মেরে দিয়ে চলে যায়।
_তোমার যেহুত কিছু হয় না, তাহলে ছোট ভাই তোমাকে একটা কথা বলি?
_বলেন।
_এখান থেকে যত দ্রুত সম্ভব কেটে পড়। এই ঝামেলার মধ্যে জড়াও না। কারণ এসব পুলিশের কেস। নানান ধরনের ঝামেলা পোহাতে হয়। ঝামেলার কোন শেষ নেই। তাই এসব থেকে মুক্ত থাকাই ভালো।
আমি ভদ্রলোকের কথা শুনে বোকা বনে গেলাম। হায়রে মানবতা। তাকে বললাম_ আঙ্কেল আজ যদি আপনার বাবা বা ভাই এভাবে এক্সিডেন্ট করে রাস্তায় পড়ে থাকত, তাহলে কি এ ধরনের কথা আপনি বলতে পারতেন? লোকটি কি যেন ভেবে বলল_ না! আমি তার জন্য এই মুহূর্তে কিছু করতে পারবো না। তুমি অন্য কোথাও চেষ্টা করে দেখতে পারো।
_ঠিক আছে! আপনার কিছু করা লাগবে না। আপনি শুধু ৯৯৯ নাম্বারে ফোন দিয়ে একটা এম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করে দেন। বাকি যা করার লাগে আমি করব। ভদ্রমহোদয় ৯৯৯ নাম্বারে ফোন দিয়ে চলে গেল।
কিছু ক্ষণের মধ্যে একটা এম্বুলেন্স চলে আসলো। লোকটাকে এম্বুলেন্সে উঠিয়ে ঢাকা মেডিকেলে যেতে বললাম। ড্রাইভার এর কাছ থেকে ফোনটা নিয়ে, আঙ্কেলের কাছে ফোন দিলাম। আঙ্কেল ঢাকা মেডিকেলের ইমার্জেন্সি বিভাগের অধ্যাপক।
মেডিকেলে পৌঁছে দেখি আঙ্কেল মেন গেটে এসে দাঁড়িয়ে আছে। আমি গাড়ি থেকে নেমে আঙ্কেলকে ঘটনার সারসংক্ষেপ শুনালাম। আঙ্কেল রোগীকে কিছুটা পর্যবেক্ষণ করে বলল_ আবির (আমার নাম) রোগীর অবস্থা তো ভয়াবহ। মনে হয় না তাকে বাঁচানো সম্ভব হবে। মাথা থেকে মগজ বেরিয়ে গেছে। আর তাছাড়া ইতিমধ্যে প্রচুর ব্লাডও ঝরে গেছে। এমত অবস্থায় এর পিছনে যা কিছু ব্যয় করা হবে, সবই যাবে বৃথা।
_আঙ্কেল এই ছোট্ট বাচ্চা মেয়েটার কথা চিন্তা করে কিছু একটা করেন। দেখেন কিভাবে বাবা বাবা বলে কান্না করছে। চেষ্টা করে দেখতে তো আর নিষেধ নেই। যদি আল্লাহ তা’য়ালা হায়াত রাখে।
_আবির আমি আমার ২১ বছরের অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি, এই রোগীকে বাঁচানো সম্ভব না। তারপরও তুমি যেহুত বলছ, চেষ্টা করে দেখতে। চেষ্টা করে দেখা যাক কি হয়!
আঙ্কেল রোগীকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। আমি বাচ্চাটাকে কাছে টেনে নিলাম। বাচ্চাটা আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে করতে বলল_ তুমি আমার বাবাকে ঠিক করে দাও। বাবা ছাড়া আমার আর কেউ নাই।
বাবা ছাড়া কেউ নাই মানে? আমি ওর কথা কিছুই বুঝতে পারলাম না। ওর মাথায় আলতে করে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললাম_কান্না করিও না। তোমার বাবা কিছু ক্ষণের মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে। এর থেকে বেশি কি বলে যে বাচ্চাটাকে সান্ত্বনা দেব, সেই ভাষা পাচ্ছিলাম না। কারণ আমি তো নিজেই একটা বাচ্চা।
ঘন্টা দুয়েক পর আঙ্কেল অপারেশন থিয়েটার থেকে বের হয়ে হতাশা নিয়ে বলল_ আবির আমি আমার জায়গা থেকে সর্বাত্মক চেষ্টা করেছি। কোন গ্রীন সিগন্যাল মেলেনি। হয়তো তার হায়াত শেষ। মাথার মগজ ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে গেছে। বুকের হাড্ডি ভেঙে হৃৎপিণ্ডর ভিতর ঢুকে গেছে। এমন রোগী এর আগে আমি আর কখনো পাইনি। সে যে এখনো জীবিত আছে, এটা আল্লাহ তা’য়ালার কুদরত ছাড়া সম্ভব’ই না। তুমি গিয়ে তার সাথে কথা বল। তার বাসার ঠিকানা বা নাম্বার নিয়ে তার বাসায় ফোন দাও। তার পরিবারের লোকজনকে আসতে বল। আমি একটু বাসায় যাব। গতকাল দুপুরে খাবার খেয়েছি। এখন পর্যন্ত পানি, বিস্কুট আর কফি ছাড়া পেটে আর কিছু যায়নি। তুমি যখন আমার কাছে ফোন দিলে, তখন আমি বাসায় যাওয়ার জন্য বেরিয়ে পড়েছিলাম। তোমার ফোন পেয়ে আবার ব্যাক এসেছি। আর ওর নাম বৃষ্টি (একজন নার্সকে দেখিয়ে বলল।) কোন কিছুর প্রয়োজন হলে ওর কাছে বলিও। আর বৃষ্টি আমি না আসা পর্যন্ত তুমি আবিরের সাথে’ই থাকবে।
আমি লোকটার কাছে গিয়ে ক্ষীণ আওয়াজে সালাম দিলাম। সে আমার দিকে এক নজর তাকিয়ে, তার মেয়েকে বুকে টেনে নিল। আমি তার কাছে তার বাসার ঠিকানা জানতে চাইলাম। লোকটা আমার হাত ধরে বলল_ বাবা আমি তোমাকে একটা অনুরোধ করবো! রাখবে?
_বলুন আঙ্কেল! আমি আপনার অনুরোধ রাখার অবশ্যই চেষ্টা করবো।
_অনুরোধটা করার আগে তোমাকে আমি আমার জীবনের কাহিনী কিছুটা শুনাই। আমার বাড়ি খাগড়াছড়ি পাহাড়ি অঞ্চলে। পাহাড়ের টিলায় ছিল আমাদের বসবাস। আমরা ছিলাম দুই ভাই বোন। আমি ছিলাম বড় আর আমার বোনটা ছিল ছোট। আমাদের টিলার সাথে ছিল ইকরাম চাচাদের টিলা। ইকরাম চাচার ছিল শুধু একটা মেয়ে। নাম ছিল মারিয়া। আমরা দু’জন ছিলাম সমবয়সী। তাই ছোটবেলা থেকেই একসাথে চলাফেরা, খেলাধুলা, পাহাড় থেকে পাহাড়ে দৌড়-ঝাপ করেই আমরা দু’জন বেড়ে উঠতে থাকি। মারিয়ার বাবা ইকরাম চাচা ছিলেন খুবই ধার্মিক লোক। আমার বাবাও ছিলেন, তবে মারিয়ার বাবার মত অতটা নয়। আমার আর মারিয়ার এইভাবে চলাফেরা, উঠাবসা, মেলামেশায় গুনাহ হবে, এই জন্য দুই পরিবার সিদ্ধান্ত নিয়ে আমাদের দু’জনকে ছোটবেলায় বিবাহ দিয়ে দেয়। যে সময় আমাদের বিবাহ দেওয়া হয়, সেই সময় আমরা এতটাই ছোট ছিলাম যে, প্রেম-ভালোবাসা, বিবাহ-বিচ্ছেদ, স্ত্রীর প্রতি স্বামীর হক, স্বামীর প্রতি স্ত্রীর হক এগুলো কিছুই বুঝতাম না। তবে শুধু এতটুকু বুঝতাম, মারিয়াকে না দেখে আমি থাকতে পারবো না আর মারিয়া আমাকে না দেখে থাকতে পারে না।
এভাবেই আমরা শৈশব ছেড়ে কৈশোর আর কৈশোর ছেড়ে যৌবনে পা রাখি। মারিয়া ছোট থেকে অনেক সুন্দরী ছিল। আর বড় হওয়ার সাথে সাথে ওর সেই সৌন্দর্যও বাড়তেই থাকে। যেন ওর সৌন্দর্যও ছিল ওর বয়সের সাথে বহমান। আমার মনে হয় পরিপূর্ণ সুন্দরী হতে একটা মেয়ের যা কিছু দরকার, সৃষ্টিকর্তা সবই ওর মধ্যে দিয়েছিল। ওর সৌন্দর্য এবং বুদ্ধিমত্তা প্রতিনিয়ত আমাকে বিমোহিত করত। শুধু আমি না! মারিয়ার সৌন্দর্যের গুনাগুন এবং বুদ্ধিমত্তার প্রশংসা ছোটবেলা থেকেই আমাদের টিলার আশপাশে যত টিলা ছিল, সেই সব টিলার লোকজনও করতো। আর পরবর্তীতেই মারিয়ার এই সৌন্দর্য’ই আমাদের দুই পরিবারের জীবনে কাল হয়ে দাঁড়ায়।
পাহাড়ি অঞ্চলের মানুষেরা খুবই অভাবে জীবন যাপন করে। অনেকের তো এমনও হয় যে, এক বেলা খাবার জুটলে আরেক বেলা না খেয়ে থাকতে হয়। আর খ্রিস্টান মিশনারীরা এই সুযোগটা কাজে লাগায়। মুসলমানদেরকে টাকা-পয়সার লোভ দেখায়। যে সব মুসলমানদের ঈমান দুর্বল, তারা ক্ষুধার তাড়না আর টাকা-পয়সার লোভে খৃষ্টান হয়ে যায়। কিন্তু যে সব মুসলমানদের ঈমান মজবুত, তাঁরা খ্রিস্টানদের পাতা ফাঁদে পা দেয় না। তখন খৃষ্টানেরা সেই সব মুসলমানদের উপর অমানবিক অত্যাচার চালায়। মুসলমানদের গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি, ফলানো ফসল জোরজবস্ত করে নিয়ে যারা নতুন খ্রিস্টান হয়, তাদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা করে দেয়।
পাহাড়ি অঞ্চলে শান্তি বাহিনী নামে একটা সংগঠন নিজেদের ইচ্ছামত রাজত্ব করে। যারা শুধু নামেই শান্তি বাহিনী। কাজ যা করে সব অশান্তির। যাদের কাছে পুলিশ, র্যাব, সেনাবাহিনীর কোন ভ্যালু নাই। ওরা নিজেদের স্বার্থ হাসিল করার জন্য যা ইচ্ছা তাই করতে পারে। পাহাড়ি অঞ্চলে প্রশাসনিক শাসন বা সরকারি আইন কানুন চলে না। আর খ্রিস্টান মিশনারি মুসলমানদের উপর অত্যাচার করার জন্য, শান্তি বাহিনীকে প্রতি মাসে মোটা অংকের টাকা দেয়।
শান্তি বাহিনীর লোকেরা বেশির ভাগ অভিযান চালায় রাতের বেলায়। যখন সবাই ঘুমে বিভোর থাকে, তখন গিয়ে তারা অকস্মাৎ হামলা করে। শুরু হয় পাশবিক নির্যাতন। সুন্দরী কোন মা-বোন পেলে তাদেরকে বানায় ভোগের বস্তু। ফিরে যাওয়ার সময় গরু-ছাগল, কাপড়-চোপড়, সোনা-দানা, নগদ টাকা-পয়সা যা কিছু পায় সব নিয়ে যায়। কেউ তাদের বাধা দেওয়ার মতো সাহস পায় না। কেউ যদি তাদের কাজ-কর্মে বাধা দিতে যায়, তো বাধা দিতে আরকি যতটুকু দেরি কিন্তু তাকে দুনিয়া ছাড়তে দেরি হয় না। অন্যায় ভাবে মানুষ হত্যা করা যেন তাদের কাছে ছোটবেলার পুতুল খেলা।
আমাদের টিলা থেকে সামান্য একটু দুরে ছোট একটা টিলা ছিল। টিলার পাশ দিয়ে বয়ে গেছে পাহাড়ি ঝর্ণা। মাটি পাথরের বুক চিরে জন্ম নিয়েছে সর্পগন্ধা ফুলের গাছ। বড় বড় পাথরকে আঁকড়ে ধরে ঝর্ণার পাশ দিয়ে এঁকেবেঁকে বহুদূর পর্যন্ত চলে গেছে জংলি ঝুমকা লতার গাছ। সব মিলিয়ে এক মনোরম পরিবেশ। কিন্তু টিলাটা ছোট হওয়ার কারণে সেখানে কেউ ঘর-বাড়ী তৈরী করতো না। আমি আর মারিয়া মাঝে মধ্যে রাতের বেলায় গিয়ে, ঝর্ণার পাশে পাথরের উপর বসে গল্প করতাম।
সেদিন রাতেও আমি আর মারিয়া ঝর্ণার পাশে বসে গল্প করতেছিলাম। হঠাৎ আমাদের টিলা থেকে শোরগোলের আওয়াজ ভেসে আসলো। কিছু বুঝে ওঠার আগেই শুরু হলো এলোপাথাড়ি গুলি বর্ষণ। আমি আর মারিয়া পাথরের পিছনে লুকিয়ে পড়লাম। লুকানো ছাড়া আর কোন রাস্তা আমাদের কাছে ছিল না। পনেরো বিশ মিনিট মত এভাবে এলোপাথাড়ি গুলি চললো। এরপর পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক মনে হলে আমরা আমাদের টিলায় গেলাম। একমাত্র আমার মা’কে ছাড়া আর কাউকে জীবিত পেলাম না। মায়ের মুখ দিয়ে বারবার হাসবি আল্লাহ বের হচ্ছিল। আমি মায়ের কণ্ঠ শুনে দৌড়ে মায়ের কাছে গেলাম। গিয়ে দেখি তাঁর শরীর রক্তে রঞ্জিত হয়ে আছে। চারটা গুলি করছে মায়ের পেটের উপর। আমি মায়ের কাছে যেতেই মা মারিয়ার কথা জিজ্ঞেস করল। মারিয়া ঠিক আছে কি না জানতে চাইল। আমি মা’কে বললাম_ মারিয়া আমার সাথেই আছে এবং ঠিক আছে। মায়ের মুখ থেকে সাথে সাথে আলহামদুলিল্লাহ শব্দটা শুনতে পেলাম। এরপর মা আমাকে বলল_ ‘বাবা! শান্তি বাহিনীর ওই শয়তানেরা এসেছিল। মারিয়াকে এক সপ্তাহের জন্য নিতে। ওদের বস নাকি মারিয়াকে অনেক পছন্দ করে। আমরা যদি তাদের এই কুপ্রস্তাবে রাজি হই আর মারিয়াকে তাদের সাথে এক সপ্তাহের জন্য পাঠাই, তাহলে তারা আমাদের দুই পরিবারের উপর আর কখনো অত্যাচার করবে না এবং আমাদেকে অনেক টাকা-পয়সা দিবে। কিন্তু বাবা আমারা কেউ তাদের এই কুপ্রস্তাবে রাজি হইনি। তাই ওরা আমাদের সবাইকে গুলি করে মেরে ফেলছে। যাওয়ার সময় টাকা-পয়সা, গরু-ছাগল, কাপড়-চোপড়, সোনা-দানা যা কিছু ছিল সব কিছুই নিয়ে গেছে। কিচ্ছু রেখে যায়নি বাবা। ওরা মারিয়ার খোঁজে আবারো আসবে। সেটা আজ হোক বা কাল। তুই মারিয়াকে নিয়ে এ রাতের অন্ধকারে অন্য কোথাও চলে যায়। যেখানে এই পাপিষ্ঠরা না পৌঁছাতে পারে। আর একটা কথা সবসময় মনে রাখবি_‘‘এই দুনিয়া দুই দিনের। কখনো টাকার লোভে পড়ে ইসলাম এবং নিজের ঈমানকে কারো কাছে বিক্রি করে দিস না।’’
আমি আর মারিয়া সবার লাশ গুলো ধরা-ধরি করে পাহাড়ি একটা গর্তে রাখলাম। কিন্তু আদরের ছোট বোনটাকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। অনেক খোঁজা-খুঁজির পর দূরে একটা পাথরের পাশে বিবস্ত্র অবস্থায় ওর লাশটা পেলাম। গর্তের মুখ পাথর দিয়ে বন্ধ করে নিজের জন্মস্থান ত্যাগ করে ঢাকার অভিমুখে রওনা দিলাম।
ঢাকায় এসে কী করব, কী খাব, কোথায় থাকবো কোন দিশা পেলাম না। না খেয়ে অনাহারে রাস্তায় রাস্তায় কয়েকটা রাতও কাটালাম। এরপর মারিয়ার গলার হার বিক্রি করে একটা বাসা ভাড়া নিলাম। কাজ হিসাবে বেছে নিলাম রিক্সা চালানো।
এভাবে আমাদের জীবন থেকে দীর্ঘ নয়টা বছর কেটে গেল। এই নয় বছরের দিনগুলো ছিলো আমার জীবনের সবচেয়ে সোরা দিন। প্রথম প্রথম কিছু দিন আমি রাতে ঘুমায়তে পারতাম না। আমার মা-বাবা, ছোট বোন, ওর মা-বাবা সবাইকে চোখের সামনে গুলি করে মেরে ফেলা হলো, কিন্তু তাদের জন্য কিছুই করতে পারলাম না। কিন্তু এই যন্ত্রণা আমাকে বেশি দিন অনুভব করতে হয়নি। ওর ভলোবাসা আমাকে সব কিছু ভুলিয়ে দিয়েছিল। ও আমাকে সবসময় আগলে রাখতো। প্রিয়জন হারানোর অভাব আমাকে বুঝতে দিত না। কিন্তু তারপরও আমি একটা সন্তানের শূন্যতা অনুভব করতাম। ওকে দেখতাম মাঝে মধ্যে রাতে বেলায় সেজদায় পড়ে কান্নাকাটি করতে। হয়তো ওর কান্নার ফলেই নয় বছর পর সৃষ্টিকর্তা আমাকে একটি কন্যা সন্তান দান করেন। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা মারিয়াকে আমার থেকে নিয়ে যায়। আর এই আমার সেই হতভাগা মেয়ে নুসাইবা তাহসিন।
এই পৃথিবীতে আমি ছাড়া ওর আপন বলতে আর কেউ নেই। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস। এই পৃথিবী আমাকেও বিদায় দিয়ে দিচ্ছে। তুমি কি বাবা আমার এই হতভাগা মেয়েটার জন্য কিছু করতে পারবা। আমি জানি তুমি এখনো অনেক ছোট। মা-বাবার দায়িত্বতেই আছো। কিন্তু তোমার কাজকর্ম এবং কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে, তুমি ছোট হলেও দায়িত্ববান একটা ছেলে। এই জন্য তোমাকে বলছি। কিছু একটা করতে পারবা আমার এই অভাগা মেয়েটার জন্য?
আমি মেয়েটার দিকে তাকালাম। গোলাপের পাপড়ির মত ফুটফুটে কিউট চেহারা। চোখদুটো মায়াবী। যা দিয়ে অঝোর ধারায় পানি পড়ছে। যেটা তার চোখে একদমই বেমানান। আমি মেয়েটার দিকে তাকিয়ে সাত পাঁচ ভাবতেছি। কি করবো আর কি বলবো। এর’ই মধ্যে ভদ্রলোক কখন যে না ফেরার দেশে চলে গেছে, সেটা বুঝতেও পারিনি।
এরপর থেকে নুসাইবা তাহসিন আমাদের বাসায়’ই থাকে। এখন আমি ওর মা-বাবা, আমি ওর ভাই-বোন, আমি ওর খেলার সাথী, আমি ওর পড়ার টেবিল, আমি ওর জীবনের সব। আমি যতক্ষণ পর্যন্ত ওর মুখের খাবার তুলে না দেই, ততক্ষণ পর্যন্ত ও খাবারও খায় না। আমি মাথায় হাত দিয়ে ঘুম না পাড়িয়ে দিলে, ঘুমাও না। আমি যদি কোন সময় বাইরে যাই, যতক্ষণ না ফিরে আসি, ও না খাবার খায়, না ঘুমায়।
একদিনের ঘটনা। আমি আম্মুর সাথে রাগারাগি করে বাসা থেকে বের হয়ে গেছি। সারাদিন বাসায় আসিনি। বন্ধুদের সাথে ঘুরাঘুরি আর আড্ডা দিয়ে মধ্যে রাতে বাসায় ফিরলাম। আস্তে আস্তে গেট খুলে রুমে গিয়ে কাঁথা মুড়া দিয়ে শুয়ে পড়লাম। হঠাৎ করে নুসাইবার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ শুনতে পেলাম। কাঁথা সরিয়ে দেখি ভাতের প্লেট নিয়ে মাথার কাছে দাঁড়িয়ে কান্না করতেছে।
_কিরে তুই! এখনো ঘুমাস নি? কান্না করছিস কেন? আর হাতে ভাতের প্লেট’ই বা কেন?
_তুমি সারাদিন কোথায় ছিলে? খাবার খাইছো?
_না! আমি খাব না। খাওয়ার রুচি নেই। তুই গিয়ে ঘুমা, যা।
_তাহলে আমিও খাব না।
_তুই সারাদিন খাস নি?
_তুমি না খাইয়ে দিলে আমি কোন দিন খেয়েছি!
বুঝতে পারলাম পাগলিটা সারাদিন খাইনি। ওর হাত থেকে ভাতের প্লেট নিয়ে কাছে বসিয়ে মুখে ভাত তুলে দিলাম।
_চোখের পানি মুছ। তোর এই চোখে পানি মানায় না।
_আগে তুমি আমার মাথায় হাত দিয়ে একটা কথা বল।
_কি বলবো, বল।
_আর কখনো এভাবে বাসা থেকে রাগ করে কোথাও যাবে না। কোথায়ও গেলা আমার কাছে বলে যাবে।
_ঠিক আছে যাবো না।
_আমার মাথায় হাত দিয়ে বলো।
_ঠিক আছে, মাথায় হাত দিয়েই বললাম। আর আমি বাসায় থাকি আর না থাকি তুই কখনো না খেয়ে থাকবি না। সময় মতো খাবার খাবি, ঠিক মতো ঘুমাবি, আর মন দিয়ে পড়াশোনা করবি। এই তিনটাই তো তোর সারাদিনের কাজ। এই যে আমি না থাকলে খাবার খাস না। অভিমান করে বসে থাকিস। ক্ষুধা লাগেনা তোর। না খেয়ে যে থাকিস, কষ্টটা কার হয় শুনি।
_যেদিন তুমি আমাকে তোমাদের এই বাসায় নিয়ে এসেছো, সে দিন থেকেই তুমি আমার জীবনের সব। তোমাকে ঘিরে’ই আমার জীবনের সব আয়োজন। একমাত্র তোমার জন্য’ই আজও আমি বেঁচে আছি। তোমার আম্মু আমাকে তাঁর নিজের মেয়ের মতো ভালোবাসে। তোমার বাবা আমাকে তাঁর নিজ সন্তানের মতো অধিকার দিয়েছে। তোমার বোন আমাকে নিজের ছোট বোনের মত ভালোবাসে। তাঁদের ঋণ আমি কোন দিন শোধ করতে পারবো না। কিন্তু তারপরেও একটা কথা মনে রেখ! যেদিন আমার মুখে খাবার তুলে দেওয়ার জন্য আর তুমি থাকবে না, সেদিন আর এই নুসাইবাও থাকবে না।
_এসব পাগলামি কথাবার্তা বাদ দিয়ে, নে ভাত নে।
_তোমাকে আমি একটা জিনিস দিব!
_কি দিবি।
_একটু ওয়েট কর, আমি আমার রুম থেকে নিয়ে আসতেছি।
এরপর দৌড়ে রুমে গিয়ে, রুম থেকে কিছু একটা নিয়ে এসে আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, _ এই নাও।
_ কি এটার মধ্যে? কোন বই-টই মনে হচ্ছে।
_বই না। ঐযে সেই নীল ডায়েরিটা। আমি এর মধ্যে অনেকগুলো গল্প লিখেছি। তুমি গল্পগুলো পড়ে তোমার অনুভূতি আমাকে জানাবা।
_ঠিক আছে! সময় সুযোগ করে পড়ার চেষ্টা করব।
_আমি তোমার অনুভূতি শুনার অপেক্ষায়…….!
_ ঠিক আছে! এবার নে তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পর। রাত প্রায় শেষ। সকালে তো আবার স্কুলে যেতে হবে।
খাবার খাওয়ানো শেষ করে, ওরে রুমে নিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে আসলাম।
এভাবেই কেটে গেল দশটা বছর। ইতিমধ্যে পড়াশোনার গণ্ডী শেষ করে, বাবার ব্যবসায়ও কিছুটা সময় দেওয়ার চেষ্টা করছি। কিন্তু বাবার কথা হল_ আমার কাঁধে ব্যবসার হাল তুলে দেওয়ার আগে, ঘরে বৌমা আনতে হবে। তাই শুরু হলো গরু খোঁজার মতো বউ খোঁজা। খোঁজা-খুঁজির কাজ শেষ করে বিবাহর দিন তারিখ ঠিক করা হল। বিবাহের যত আয়োজন এবং কাজ-কর্ম বাবা সব আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিল। তাই সব মিলিয়ে কয়েকদিন অনেক ব্যস্ত সময় পার করতে হচ্ছিল। বিয়ের পাঁচ দিন আগে। গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজে সারাদিন বাসার বাহিরে। এখান থেকে ওখানে দৌড়াদৌড়ি করতে হল। কিন্তু কাজের কাজ আর হল না। শুধু মাথাটা গরম হল। সন্ধ্যায় আম্মুর ফোন।
_কিরে তোর কাজ শেষ হয়নি? বাসায় আসবি কখন? তাড়াতাড়ি বাসায় আয়! নুসাইবা সারাদিন কিছু খাইনি। তোর জন্য বসে আছে।
_আম্মু ও তো এখনো ছোট নেই। বড় হয়েছে। ওর বয়স এখন ষোল। এখনো যদি মুখে তুলে খাবার খাইয়ে দেওয়া লাগে। তো দু’দিন পর যখন ওর বিয়ে হবে, বাচ্চা-কাচ্চা হবে, তখন ওর বাচ্চা-কাচ্চার মুখে খাবার তুলে খাওয়াবেকে শুনি? কে খেয়ে আছে আর কে না খেয়ে আছে, এসব শুনতে এখন আর আমার ভালো লাগতেছেনা। তুমি ওরে বলো_নিজে নিজে খাবার খেয়ে নিতে। আমার আসতে দেরি হবে। রাখি…..!
কাজ শেষ করে বাসায় আসতে আসতে রাত প্রায় এগারোটা বেজে গেল। এসে দেখে আম্মু ডাইনিং রুমে বসে আছে।
_কি তুমি এখনো ঘুমাওনি?
_নুসাইবা রুমের ভেতর থেকে দরজা লাগিয়ে দিয়েছে। কত করে ডাকা-ডাকি করতেছি, কিন্তু দরজা খুলতেছে না।
_কোন সময় থেকে দরজা লাগানো?
_এই তো ঘন্টাখানেক হবে।
_ঘুমাইছে নাকি?
_ঘুমানোর সময় তো কখনো ও দরজা লাগায় না। তুই একটু দেখ তো বাবা।
আমিও অনেক ডাকাডাকি করলাম কিন্তু ভেতর থেকে কোন আওয়াজ পেলাম না। সর্বশেষ কোন উপায় না পেয়ে দরজা ভাঙতে বাধ্য হলাম। দরজা ভেঙ্গে দেখি পাগলিটা ভীষণ অভিমান করেছে। নিজের ওড়না ফ্যানের সাথে বেঁধে গলায় ফাঁস নিয়ে পৃথিবীকে বিদায় জানিয়েছে। আমি একটা চিৎকার দিয়ে ওকে গিয়ে জড়িয়ে ধরলাম। বাবা এসে ওর গলা থেকে ওড়নাটা খুলে নিচে নামালো। পাগলিটা এমন কেন করল? আমাকে বাসায় আসতে দেরি হয়েছে, তাই? নাকি অন্য কিছু?
আমি কাঁপা কাঁপা শরীর নিয়ে ওর টেবিলের পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। টেবিলের উপর দেখি একটা চিরকুট লিখে রাখছে…! আমার জন্মের বহুদিন আগে, এই পৃথিবী থেকে আমার দাদা-দাদি, নানা-নানি বিদায় নিয়েছে। আমার জন্মের সময় আমার আম্মু মারা গেল। এরপর থেকে বাবাই আমার জীবনের সব ছিল। কিন্তু সে বাবার ভালোবাসাও আমার কপালে বেশি দিন জুটলো না। তিনিও আমাকে রেখে বিদায় নিল। এরপর তুমি আমাকে নিয়ে আসলে। এতদিন তুমি ছিলে আমার জীবনের সব। তোমাকে নিয়ে কল্পনা করে আমি প্রতিটি দিন কাটে। আমি তোমাকে ছাড়া কোন কিছুই ভাবতে পারিনা। এমনকি তোমাকে ছাড়া আমি খাইতে পর্যন্ত পারি না। তোমাকে একদিন আমি বলেছিলাম_যেদিন আমাকে আর মুখে খাবার তুলে দেওয়ার জন্য তুমি থাকবে না। সেদিন আমিও থাকব না। দেখ! পৃথিবীতে সবাই সবকিছুর ভাগ দিলেও ভালোবাসার ভাগ কখনো কেউ দিতে চায় না। তোমাকে আমি পাগলের মত ভালবাসতাম। কিন্তু সেটা আমি কখনো তোমাকে বোঝাতে পারিনি।
আগে তুমি বাসায় ঢুকে সর্বপ্রথম নুসাইবা বলে ডাক দিতে। তুমি দেরি করে বাসায় আসলে আমি অভিমান করে বসে থাকতাম। তুমি আমাকে গল্প বলে, গান শুনিয়ে রাগ ভাঙ্গাতে। আমার মাথায় হাত দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিতে। কিন্তু দেখ! তুমি আজ তিন দিন আমার রুমে পর্যন্ত আসোনি। আমি খেয়েছি কিনা একবারও জিজ্ঞেস করোনি। বলতে পারবা_ তুমি আমাকে নিয়ে আসার পর থেকে আজ পর্যন্ত, তুমি খাবার খাওয়ায়ে দেওয়া ছাড়া আমি খাবার খেয়েছি। তাহলে তুমি কিভাবে বলতে পারলে, একা একা খেয়ে নিতে। তোমাকে আমি একটা ডায়েরি দিয়েছিলাম পড়ার জন্য। বলেছিলাম ডায়েরিটা পড়ে তোমার অনুভূতি আমাকে জানাতে। কিন্তু তুমি ডায়েরিটা পড়া তো দূরের কথা, ডায়েরি থেকে গিফট কাগজও এখন পর্যন্ত খুলো নাই। ওটা এখনো ওই ভাবেই তোমার টেবিলের ড্রয়ারে পড়ে আছে। ডায়েরিটা যদি পড়তে, তাহলে নিশ্চয়ই ………না থাক আর বলে লাভ নেই ! যদি পারো আমাকে ক্ষমা করে দিও।
ইতি
নুসাইবা তাহসিন
নুসাইবা মারা যাওয়ার পর তিন দিন পর্যন্ত আমার পেটে পানি ছাড়া আর কিছুই গেল না। ওর হারানোর শোকে আমি মানসিক ভারসাম্য আমি হারিয়ে ফেললাম। ওরে যে আমি নিজেই এতো ভালোবেসে ফেলেছিলাম, সেটা হারিয়ে যাওয়ার আগে কখনো বুঝতে পারিনি।
আমার মানসিক অবস্থা আস্তে আস্তে খারাপের দিকে যেতে থাকলো। চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি করা হলো। কিন্তু কোন কাজ হলো না। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য আমাকে মালয়েশিয়া নিয়ে যাওয়া হলো। সেখানে চিকিৎসা করার পর কিছুটা সুস্থ হলাম। পরে মামা আমাকে নিউইয়র্কে নিয়ে গেল। সেখানে তার বিশাল ব্যবসা। সেই ব্যবসার কিছুটা দায়িত্ব আমার ঘাড়ে তুলে দিল। যেন আমি কাজের মধ্যে থেকে নুসাইবা কে ভুলে যেতে পারি। কিছুদিন পর মামার বিদেশি একমাত্র সুন্দরী মেয়ের দায়িত্বও আমার কাঁধে তুলে দিতে চাইল। চলে এলাম দেশে। নুসাইবা কে একটি মুহুর্তের জন্যও ভুলতে পারতেছি না। জেগে থাকলে ওর স্মৃতিগুলো আমাকে কুড়ে-কুড়ে খায় আর ঘুমাইলে ওর ভালোবাসা আমাকে তাড়া করে বেড়ায়।
সবকিছু কেমন যেন দূরের হয়ে গেছে। চারপাশের কোলাহল আর আগের মতো টানে না। নিজের ভেতরেই যেন একটা অদৃশ্য দেয়াল তুলে ফেলেছি, কারও শব্দ সেখানে পৌঁছায় না। কথাগুলো গলায় আটকে যায়, চোখের ভাষাও এখন বোবা হয়ে গেছে। আগে যেগুলো আনন্দ দিত, এখন সেগুলোতে খুঁজে পাই শূন্যতা। মানুষের ভিড়ে থাকলেও নিজেকে অচেনা মনে হয়। মন চায় নির্জন কোন নদীর তীরে বসে থাকি চুপচাপ, যেন সময় থেমে যায় কিছুক্ষণের জন্য। কোলাহল থেকে অনেক দূরে, শুধু নিঃশ্বাসের শব্দ আর নীরবতার সঙ্গ।
তবে এখন রোজ’ই নিয়ম করে ওর কবরের পাশে যাওয়া হয়। সেই নীল ডায়েরি পড়ে পড়ে আমার অনুভূতি শুনাই। মাঝে মাঝে ওর কাছে খুব করে জানতে ইচ্ছে করে_কেন করলি এমন? আমাকে এতটা ভালোবাসতি, সরাসরি কেন বললি না? আমি ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া ছাড়া তোর ঘুম আসতো না! এখন তুই কিভাবে ঘুমাস? কিন্তু ও এতটাই অভিমান করছে যে, আমার কোন প্রশ্নেরই এখন আর উত্তর দেয় না।
আমি ফুরিয়ে যাচ্ছি, হারিয়ে যাচ্ছি
কোন এক মৌন আর্তনাদে
এক শিশিরে নিঃশব্দ প্রতিবাদে।