ছফওয়ান আল মুসাইব

মানুষ কেন মানুষকে ভালোবাসে

মানুষ কেন মানুষকে ভালোবাসে

কখনো কি ভেবে দেখেছেন, হাজারো মানুষের ভিড়ে কেন কিছু নির্দিষ্ট মুখ আমাদের কাছে হঠাৎ করেই খুব আপন মনে হয়? কেন কিছু মানুষের প্রতি আমাদের একটা আলাদা টান তৈরি হয়? এটা কি শুধুই ভাগ্যের খেলা, নাকি এর পেছনে রয়েছে আরও মজার কিছু কারণ?

আসলে, মানুষের মন বেশ অদ্ভুত। আমরা কেন কাউকে পছন্দ করি বা ভালোবাসি, এর পেছনে কিছু দারুণ মজার মনস্তাত্ত্বিক কারণ লুকিয়ে থাকে। এগুলো কোনো জটিল বিজ্ঞান নয়, বরং আমাদের প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা থেকেই আমরা এগুলো বুঝতে পারি।

১. বাহ্যিক আকর্ষণ;

প্রথমে একটা সহজ কথা বলি, যা হয়তো অনেকেই মানতে চাইবেন না এবং শুনতে কিছুটা হাস্যকর কিন্তু এটাই সত্যি, আমরা সুন্দর চেহারার মানুষকে বেশি পছন্দ করি! অর্থাৎ স্বাভাবিকভাবেই আমাদের মন আকর্ষণীয় চেহারার মানুষের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে যায়। আর তখন তার প্রতি আমাদের অবচেতন মন এক ধরনের ইতিবাচক ধারণা তৈরি করে এবং তার প্রতি ভালো লাগা কাজ করে। এটা একদম স্বতঃস্ফূর্ত একটা ব্যাপার।

বিষয়টি সবচেয়ে ভালোভাবে বোঝা যায় মার্কেটিং বা বিজ্ঞাপনের দিকে তাকালে। বিলবোর্ড, টেলিভিশন বা যেকোনো পণ্যের বিজ্ঞাপনে কেন আকর্ষণীয় মডেলদের ব্যবহার করা হয়? কারণ কোম্পানিগুলো জানে, একজন সুন্দর মডেল বা উপস্থাপক পণ্যের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রভাবিত করতে পারে। আমরা যখন কোনো সুন্দর, আকর্ষণীয় ব্যক্তিকে দেখি, তখন তার সঙ্গে জড়িত বিষয়গুলোকেও ইতিবাচকভাবে দেখার প্রবণতা তৈরি হয়। আর এটাকেই মনোবিজ্ঞানের ভাষায় Halo Effect বলা হয়, যা কাউকে ভালো লাগা, ভালোবাসা বা অন্যের প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার প্রথম ধাপ। 

২.মনের মিল ও একাত্মতা;

এই কারণটা আরো দারুণ মজার! যখন আমরা বুঝতে পারি যে, আমাদের আশেপাশের কোন ব্যক্তির সাথে আমাদের অনেক কিছু মিলে যাচ্ছে, তখন তাদের প্রতি আমাদের একটা আলাদা টান তৈরি হয়। 

ধরুন, আপনি কোনো ব্যান্ডকে পাগলের মতো ভালোবাসেন, আর হঠাৎ দেখলেন আপনার কলিগ অথবা ক্লাসমেটও সেই ব্যান্ডের ডাই-হার্ড ফ্যান! ব্যস, সঙ্গে সঙ্গেই দেখবেন তার সাথে আপনার খুব ভাব জমে যাবে। বা ধরুন আপনি একটা নতুন অফিসে জব শুরু করলেন। তা প্রথমদিন যাওয়ার পরে সবাই অপরিচিত। কিন্তু হঠাৎ দেখলেন, আপনার কলিগদের মধ্য থেকে একজন  আপনার আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতেছে। এখন সে আপনার অঞ্চলের না হলেও, দেখবেন আপনার ঘনিষ্ঠতা তার সাথে সর্বপ্রথম হবে। অথবা ধরুন আপনি একজন রাজনীতিবিদ, দূরে কোথায় সফরে যাচ্ছেন। হঠাৎ প্রতিমধ্যে দু’জন ব্যক্তির সাথে আপনার সাক্ষাৎ হল, যারা অপরিচিত। তাদের মধ্যে একজন পাইলট, অপরজন রাজনীতিবিদ। এখন বলেন তো, আপনার ভাব কার সাথে বেশি গভীর হবে ? নিঃসন্দেহে রাজনীতিবিদের সাথে। কারণ আপনারা একই ব্যাকগ্রাউন্ডের। আপনি রাজনীতিবিদ হওয়ার কারণে অপর রাজনীতিবিদকে যতটুকু বুঝবেন, পাইলটকে তার দশ ভাগও বুঝতে পারবেন না।

আর এই যে এমন ছোট ছোট মিলগুলো’ই আমাদের মধ্যে একটা অদৃশ্য সেতু তৈরি করে। সেটা হতে পারে একই এলাকার বাসিন্দা, একই ধরনের রসবোধ, রাজনীতি, ধর্ম, সামাজিক কোনো বিষয়ে বা এমনকি কথা বলার ধরনও মানুষকে কাছাকাছি নিয়ে আসে। আর এটাই হল Similarity-Attraction Effect বা অন্যের প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার দ্বিতীয় কারণ।

৩. লাইকিং বায়াস; 

সহজভাবে বললে, যখন আমরা বুঝি যে অন্য কেউ আমাদের পছন্দ করে, তখন আমরাও তাকে পছন্দ করা শুরু করি! এটা একটা প্রাকৃতিক প্রতিক্রিয়া। যখন কেউ আমাদের কথা মনোযোগ দিয়ে শোনে, আমাদের গুরুত্ব দেয়, বা আমাদের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব দেখায়, তখন স্বাভাবিকভাবেই আমাদের মনে তাদের প্রতি একটা ভালো লাগা তৈরি হয়।

একটা উদাহরণ দিয়ে বুঝি। ধরুন আপনি একটু সমস্যায় পড়েছেন, বিষয়টি আপনি আপনার ফ্রেন্ড সার্কেলের মধ্যে শেয়ার করলেন। পুরা ফ্রেন্ড সার্কেলের মধ্যে একজন আপনার সমস্যাটা প্রথমে খুবই মনোযোগ সহকারে গুরুত্ব দিয়ে শুনলেন, এরপরে কিভাবে সেটা সমাধান করবেন, সেটা হাসি মুখে বললেন এবং আপনাকে সামনে অগ্রসর হওয়ার জন্য উৎসাহ দিলেন। অতঃপর যতক্ষণ পর্যন্ত না সেটা সমাধান হয়, ততক্ষণ আপনার সাথে রইলেন বা হাসিমুখে সব সময় আপনার সমস্যার খোঁজ-খবর নিলেন। এখন দেখবেন, আপনার সব ফ্রেন্ড সার্কেলের মধ্যে থেকে তাকেই আপনার সব থেকে বেশি ভালো লাগবে। কারণ তার ইতিবাচক আচরণ আপনার মনে এই ধারণা জন্মায়ছে যে, সে আপনাকে একজন মূল্যবান বন্ধু হিসেবে পছন্দ করে।

মনোবিজ্ঞানের ভাষায় এই ব্যাপারটিকে লাইকিং বায়াস বলা হয়। এটি আমাদের মস্তিষ্কের একটি শর্টকাট, যার কারণে আমরা পছন্দের মানুষের কথা সহজে বিশ্বাস করি, তাদের দ্বারা প্রভাবিত হই এবং তাদের ভুলগুলোও এড়িয়ে যাই।

শেষ কথা; এই তিনটি কারণ মিলিয়েই তৈরি হয় আমাদের পছন্দের জগৎ। অতএব এখন বুঝতেই পারছেন, মানুষ কেন মানুষকে পছন্দ করে বা তার প্রতি আকৃষ্ট হয় ? পরের বার যখন কাউকে আপনার ভালো লাগবে, একটু ভেবে দেখবেন—এর পেছনে আসলে কোন কারণটি কাজ করছে? বাহ্যিক সৌন্দর্য, মনের মিল, নাকি সেই মানুষটির আপনার প্রতি দেখানো ভালোবাসা? উত্তর যাই হোক, মানুষের সঙ্গে মানুষের এই অদৃশ্য আকর্ষণই আমাদের জীবনকে আরও সুন্দর, রঙিন আর বৈচিত্র্যময় করে তোলে!

আমার সম্পর্কে

আমি ছফওয়ান আল মুসাইব, একজন 3D আর্টিস্ট, ভিডিও এডিটর। 3D আর্টের প্রতি গভীর ভালোবাসা থেকেই আমি আমার ক্যারিয়ার শুরু করি, এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজের দক্ষতা গড়ে তুলেছি। পেশাগত জীবনে সাফল্যের পাশাপাশি আমি গল্প লেখা এবং ভ্রমণে দারুণ আগ্রহী। শখের বসে মাঝে মাঝে হাতে কলম তুলে নিই এবং আমার মনের ভাবনা ও অনুভূতিগুলোকে শব্দে রূপ দিই। আমার লেখা গল্পগুলো বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছে, যা অনেক পাঠকের হৃদয় ছুঁয়ে গেছে।

জনপ্রিয় পোস্ট

সাম্প্রতিক পোস্ট