ছফওয়ান আল মুসাইব

বেস্ট ফ্রেন্ড

বেস্ট ফ্রেন্ড | ছফওয়ান আল মুসাইব | বন্ধুত্বের গল্প

শখ করে Veloce Legion 50 মডেলের একটা বাইসাইকেল কিনেছিলাম। সাইকেলটা হাতে পাওয়ার পরের কয়েকটা দিন ছিল সত্যিই রোমাঞ্চকর। নতুন সাইকেল নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো, আর মনের কোণে লং ড্রাইভের নানা স্বপ্ন—সবকিছুই ছিল দারুণ উপভোগ্য। মনে হতো, একদিন সাইকেল নিয়ে প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে যাব, দূর কোন শান্ত গ্রামে বা নদীর ধারে গিয়ে প্রশান্তি খুঁজে ফিরব। কিন্তু সেই স্বপ্ন বাস্তবের মুখ দেখল না। ব্যস্ততার কঠিন জালে আটকে পড়ে, সেই ইচ্ছা পূর্ণ করার আগেই হারিয়ে গেল।

সময় যেন দিন দিন আরও অনিয়ন্ত্রিত হয়ে উঠল। কাজের চাপ, ব্যক্তিগত দায়িত্ব, পড়ালেখা—সবকিছু মিলিয়ে দিনগুলো ক্রমেই ব্যস্ততায় ডুবে গেল। প্রতিদিনের রুটিনে নিজেকে খুঁজে পাওয়া মুশকিল হয়ে পড়ল। সেই শখ করে কেনা সাইকেলটা ঘরের এক কোণায় পড়ে রইল! যেটা একসময় ছিল স্বপ্নের সঙ্গী, সেটা চলে গেল অব্যবহৃত জিনিসের তালিকায়। দিন যায়, রাত যায়, সপ্তাহ পেরিয়ে মাসও চলে যায়, কিন্তু সাইকেলের চাকা আর ঘোরে না। শখের সাইকেলটা যেন ঘরের এক কোণে পড়ে থাকা শুধুই নীরব স্মৃতি। 

একদিন বিকেলে সাইকেলটার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ একটা চিন্তা মাথায় এল—এভাবে ফেলে রাখার কোনো মানে হয়? সাইকেলটা তো নতুনই আছে, অথচ কোনো কাজে আসছে না। তাহলে বিক্রি করে দেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। এভাবে পড়ে থাকলে তো কোনো লাভ নেই, তার চেয়ে কিছু টাকা পাওয়া গেলে, সেটি কাজে লাগানো যাবে। 

এই ভাবনা মাথায় নিয়েই এলাকার এক সিনিয়র ভাইয়ের সঙ্গে কথা বললাম। উনি বাইসাইকেলটার ব্যাপারে বেশ আগ্রহ দেখালেন। সাইকেল দেখে বললেন, ‘এটা তো বেশ ভালোই দেখাচ্ছে! দাম কত চাচ্ছ?’  

আমি বললাম, ‘১৯ হাজার টাকা।’  

তিনি কিছুক্ষণ ভেবে বললেন, ‘ঠিক আছে, দামটা ঠিক আছে। সময় করে তোমার বাসায় এসে সাইকেল নিয়ে যাবো।’  

আমিও বললাম, ‘ঠিক আছে, যখন সময় পান তখন এসে নিয়ে যাবেন।’

পরদিন সকালে সেই সিনিয়র ভাই টাকা নিয়ে আমার বাসায় এলেন। আমি ভদ্রতার খাতিরে তার জন্য কিচেনে কফি বানাচ্ছিলাম। এমন সময় আমার বন্ধু রোহান হঠাৎ বাসায় এসে হাজির। সে কিছুটা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কিরে, লোকটা কে? তোদের বাসায় তো এর আগে কখনো দেখিনি!’  

আমি হেসে বললাম, ‘আরে, সাইকেলটা বিক্রি করব। উনি সেটাই কিনতে এসেছেন।’  

রোহান আরও বেশি অবাক হয়ে বলল, ‘কেন, সাইকেল বিক্রি করছিস কেন? এত শখ করে কিনলি তো!’  

আমি হেসে বললাম, ‘শখ তো ছিল, কিন্তু সময় কই? ব্যস্ততায় এত ডুবে আছি যে, চালানোর সুযোগই পাই না। তাই ভাবলাম, শুধু শুধু ফেলে না রেখে বিক্রি করে দিই।’  

রোহান কিছুক্ষণ চুপচাপ আমার দিকে তাকিয়ে থাকল। হয়তো সে ভেবে নিচ্ছিল, আমি কেন হঠাৎ সাইকেল বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিলাম। তারপর হঠাৎ বলল, ‘তাহলে বিক্রি করার আগে আমাকে তো বলতে পারতি!’  

আমি কিছুটা অবাক হয়ে বললাম, ‘কেন? সাইকেল কি তুই নিবি নাকি?’  

রোহান মুচকি হেসে সরাসরি জবাব দিল, ‘হ্যাঁ, আমি নিতাম!’  

রোহানের এই কথায় আমি এক মুহূর্তের জন্য থেমে গেলাম। মনের ভেতর এক ধরনের দ্বিধা কাজ করতে শুরু করল। একদিকে এলাকার সেই সিনিয়র ভাই, যাকে কথা দিয়ে ফেলেছি—সাইকেল বিক্রি করব বলে। অন্যদিকে রোহান, আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু, যে কিনা জীবনের নানা মোড়ে সব সময় পাশে থেকেছে। বন্ধুত্বের এই অটুট বন্ধন আমাকে একধরনের মানসিক টানাপোড়েনের মধ্যে ফেলে দিল। সিনিয়র ভাইয়ের প্রতি ভদ্রতা বজায় রাখা উচিত, কিন্তু রোহান—সে তো শুধু বন্ধু নয়, আমার জীবনের বহু স্মৃতির সঙ্গী। চিন্তা করতে করতে বুঝলাম, বন্ধুর প্রতি আমার আবেগ আর সম্পর্কের গুরুত্ব অন্য যেকোনো সম্পর্কের চেয়ে অনেক বেশি। বন্ধুত্বের মানে শুধু মধুর সময় ভাগাভাগি করা নয়, বরং তার চেয়ে বড় কিছু। সেই অনুভূতির কথা মনে করেই শেষমেশ সিদ্ধান্ত নিলাম—বন্ধুর কথাই মেনে নেব। বন্ধুত্বের মূল্য যে কারো চেয়ে বেশি।

তাই এলাকার সেই সিনিয়র ভাইয়ের সামনে গিয়ে, কিছুটা অস্বস্তি নিয়ে বললাম, ‘বড় ভাইয়া, আমি আসলেই খুব দুঃখিত। হঠাৎ করেই আমি আমার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছি, তাই আমি আপনাকে সাইকেলটা দিতে পারছি না। এজন্য সত্যিই আমি দুঃখিত। আপনি যদি এর সাথে আরো কিছু টাকা যোগ করেন, তাহলে  নতুন সাইকেল নিয়ে নিতে পারেন।’

এই কথাগুলো বলতেই তার চোখ-মুখ কালো হয়ে গেল। তিনি কিছুক্ষণ চুপচাপ আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন, যেন আমার কথা বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। তার হাতে ধরা কফির মগটা ধীরে ধীরে টেবিলে রেখে তিনি কোনো কথা না বলেই মাথা নিচু করে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। আমি কিছুটা অস্বস্তি অনুভব করলাম। মনে হচ্ছিল, আমি হয়তো তার সঙ্গে অন্যায় করলাম, তার বিশ্বাসের মর্যাদা রাখতে পারলাম না। কিন্তু তা সত্ত্বেও, পরিস্থিতি যা-ই হোক, বন্ধুর জন্য তো এটুকু করতেই হয়। রোহান আমার বেস্ট ফ্রেন্ড, আর বন্ধুত্বের জন্য এইটুকু ত্যাগ করাই যায়।

এরপর আমি এক মুহূর্তও দেরি না করে রোহানের দিকে তাকালাম, একটা হাসি দিয়ে সাইকেলের চাবিটা তার হাতে তুলে দিলাম। সে খুশি মনে সাইকেল নিয়ে চলে গেল, যেন সে যা চেয়েছিল, সেটা পেয়েই দারুণ সন্তুষ্ট। আমি তাকে যেতে দেখলাম, আর মনে হলো, আমি ঠিক কাজটাই করেছি। বন্ধুত্ব মানেই তো এমন এক সম্পর্ক, যেখানে কোনো শর্ত থাকে না, কথা না বললেও বোঝাপড়া থাকে, আর বন্ধুর প্রয়োজনই থাকে সবার আগে। রোহানের জন্য এই সামান্য ত্যাগ করতে পেরে আমার মনটা হালকা লাগল। বন্ধুত্বের এই বন্ধনটাই তো জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। 

ঘণ্টাখানেক পর রোহান আবার আমার বাসায় ফিরে এল। এসেই সে একটা খাম বের করে ১৪ হাজার টাকা আমার হাতে ধরিয়ে দিল। আমি চুপচাপ টাকা নিয়ে ড্রয়ারে রেখে দিলাম, কোনো কথা বললাম না। কারণ, টাকার ব্যাপারটা আমার কাছে তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়, বিশেষ করে রোহানের ক্ষেত্রে। সে যদি এক টাকাও না দিত, তবুও আমার কোনো আপত্তি থাকত না। 

টাকা-পয়সার হিসাব বন্ধুত্বের মাপকাঠি হতে পারে না। বন্ধুত্বের মূল যে জায়গাটা, সেটাই আসল—বিশ্বাস, নির্ভরতা, এবং একে অপরের প্রতি নিঃস্বার্থ ভালোবাসা। রোহান শুধু আমার বন্ধু নয়, সে আমার জীবনের সেই মানুষ, যার সঙ্গে কোনো কিছুই মাপা-ঝোঁকা করতে হয় না। তার জন্য কোনো কিছু চাওয়া বা পাওয়ার প্রয়োজন হয় না। এই সম্পর্কের ভিত্তি শুধুই হৃদয়ের, সেখানে টাকার মূল্য একেবারেই গৌণ। সুতরাং বেস্ট ফ্রেন্ডের জন্য এমন ছোটখাটো ত্যাগ আসলে কিছুই নয়। এটা তো বন্ধুত্বের সৌন্দর্য—যেখানে বিনিময়ের চেয়ে হৃদয়টাই প্রাধান্য পায়।

পরের দিন সকালে বাইরে বের হয়ে দেখি, এলাকার সেই সিনিয়র ভাই সাইকেল নিয়ে রাস্তায় বেশ ফুরফুরে মেজাজে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। সাইকেলটা যেন তার হাতের সঙ্গে বেশ খাপ খেয়েছে, আর মুখে হাসি। আমায় দেখে দূর থেকেই তিনি মুচকি হেসে একটা ধন্যবাদ দিলেন। আমি কিছুটা অবাক হলাম—ধন্যবাদটা ঠিক কেন দিলেন, সেটাই যেন মাথায় ঢুকছিল না। কৌতূহল আর দ্বিধা নিয়ে কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ধন্যবাদ কেন দিলেন, ভাই? কিছু বুঝতে পারছি না।’

তিনি হেসে উত্তর দিলেন, ‘আরে ভাই, তোমার সাইকেলটা আমার অনেক আগে থেকেই পছন্দ ছিল। আমি বেশ কিছুদিন ধরে ভাবছিলাম যে একটা সাইকেল কিনব, কিন্তু বাজারে তোমার মডেলের সাইকেল থাকলেও এই বিশেষ কালারটা পাচ্ছিলাম না। তোমার সাইকেলটা না পাওয়ায় একটু মন খারাপ হয়েছিল। তবে পরে যখন দেখলাম, তুমি তোমার বন্ধুর মাধ্যমে আমার কাছে সাইকেলটা পাঠিয়ে দিয়েছ, তখন তো খুশি হয়ে গিয়েছিলাম! এজন্যই ধন্যবাদ দিচ্ছি। আর হ্যাঁ, টাকাগুলো ঠিকঠাক মতো পেয়েছো তো? তোমার বন্ধুর কাছে পাঁচশ’ টাকা বেশি দিয়েছি—মিষ্টি খাওয়ার জন্য! মোট ১৯,৫০০ টাকা।’

তার কথা শুনে আমি পুরোপুরি হতবাক হয়ে গেলাম। মাথায় যেন কেমন ঘুরে উঠল। সাইকেলটা তো রোহান নিল! কিন্তু চালাচ্ছে সেই সিনিয়র ভাই? আর টাকা? ১৯,৫০০ টাকা থেকে ১৪,০০০ কীভাবে হয়ে গেল? পুরো ব্যাপারটা যেন অদ্ভুত, কিছুই যেন ঠিকঠাক বোঝা যাচ্ছে না। রোহান তো আমার বেস্ট ফ্রেন্ড, তার ওপর পুরোপুরি বিশ্বাস করি। তবে কি কোনো ভুল বোঝাবুঝি হলো? নাকি রোহান কিছু বলার চেষ্টা করেছিল, যা আমি বুঝতে পারিনি? 

এমন মাথায় অজস্র প্রশ্ন মনের মধ্যে ঘুরপাক খেতে লাগল। তবে চিন্তাগুলো গুছিয়ে আনার চেষ্টা করলাম, কিন্তু কিছুই স্পষ্ট হল না। সবকিছু যেন ধাঁধার মতো লাগতে লাগলো—একটা সাইকেল, দুজন মানুষ, আর অঙ্কের হিসাব মিলছে না। 

মাথা ক্রমশ ভারী হয়ে গেল, মনে হতে লাগলো যেন আমি পৃথিবীর চারদিকে ভনভন করে ঘুরছি। না, আসলে আমি না, পৃথিবী আমার চারদিকে ঘুরছে। সবকিছু ঝাপসা! দ্রুত বাসার দিকে হাঁটা শুরু করলাম!

আমার সম্পর্কে

আমি ছফওয়ান আল মুসাইব, একজন 3D আর্টিস্ট, ভিডিও এডিটর। 3D আর্টের প্রতি গভীর ভালোবাসা থেকেই আমি আমার ক্যারিয়ার শুরু করি, এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজের দক্ষতা গড়ে তুলেছি। পেশাগত জীবনে সাফল্যের পাশাপাশি আমি গল্প লেখা এবং ভ্রমণে দারুণ আগ্রহী। শখের বসে মাঝে মাঝে হাতে কলম তুলে নিই এবং আমার মনের ভাবনা ও অনুভূতিগুলোকে শব্দে রূপ দিই। আমার লেখা গল্পগুলো বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছে, যা অনেক পাঠকের হৃদয় ছুঁয়ে গেছে।

জনপ্রিয় পোস্ট

সাম্প্রতিক পোস্ট