বন্ধুত্ব—এই শব্দটার ভেতর এক অদ্ভুত জাদু লুকিয়ে আছে। দু’জন মানুষের আলাদা জগত যখন এক সুতোয় বাঁধা পড়ে, তখনই জন্ম নেয় বন্ধুত্বের। আর সেই বন্ধনে থাকে গভীর আস্থা, নির্ভেজাল নির্ভরতা আর এক নিঃস্বার্থ ভালোবাসা।
আমরা বন্ধুরা মিলে হাসি, কাঁদি, একসাথে স্বপ্ন দেখি আর বিপদে-আপদে সবার আগে একে অপরের পাশে দাঁড়াই। কত শত গোপন কথা, কত না বলা কষ্ট, সব কিছুই একে অপরের কাছে নির্দ্বিধায় সঁপে দেই।
কিন্তু সেই সম্পর্কে যদি কখনো ভাঙন ধরে? কিংবা কোন কারণে অভিমান আর ভুল বোঝা-বুঝির পাহাড় জমে যায়, তখন কি হয়?
আসলে সম্পর্ক ভেঙে যাওয়া নতুন কোনো ঘটনা নয়। জীবন যেমন পরিবর্তনশীল, সম্পর্কও ঠিক তেমনি। আমরা অনেকে সম্পর্ক ভেঙে গেলে হতাশ হয়ে পড়ি। কিন্তু আমরা কি কখনো ভেবে দেখেছি, এই ভাঙনের মধ্য দিয়েই আমাদের সঙ্গীর আসল পরিচয়টা বেরিয়ে আসে?
আমি মনে করি, একটি সম্পর্ক বা বন্ধুত্বের মধ্যে মাঝেমধ্যে মান-অভিমান কিংবা ভুল বোঝাবুঝি হওয়া প্রয়োজন। এতে সম্পর্কের গভীরতা বা দৃঢ়তা যাচাই করার সুযোগ থাকে। তখন আমরা খুব সহজে বুঝতে পারি, যাকে আমরা সঙ্গী হিসেবে বেছে নিয়েছি, সে আসলে কেমন।
একটি বন্ধুত্ব বা সম্পর্ক ভেঙে যাওয়া, অথবা ভুল বোঝাবুঝি হওয়ার পর মানুষ সাধারণত দুই ধরনের আচরণ করে। আর তার এই আচরণ থেকেই বোঝা যায়, সম্পর্কের প্রতি তার সম্মানবোধ কতটা গভীর এবং সঙ্গে হিসেবে সে কেমন?
১. আমাদের মধ্যে কেউ কেউ এমন আছে, যারা সম্পর্ক ভাঙার কষ্ট নীরবে সহ্য করে কিংবা ভুল বোঝাবুঝি হলে, বিষয়টা সমাধান করার চেষ্টা করে। তাদের মনের ভেতরে কষ্ট, রাগ, অভিমান জমে থাকলেও তারা তা নিজের মধ্যেই সামলে নেন। কিংবা নীরবে দূরে সরে যান এবং কখনোই অন্যের সামনে তার এই সম্পর্কের সম্মান নষ্ট করে না। কারণ তারা জানে, শুধু সম্পর্ক নয় সম্পর্কের মর্যাদা রক্ষা করাও জরুরি, এমনকি সেই সম্পর্ক বা বন্ধুত্ব ভেঙে গেলেও।
২. অন্যদিকে, কিছু মানুষ আছে যারা নিজেদের ভেতরের রাগ আর দুঃখকে অন্যের সামনে ছড়িয়ে দেন। তারা তার সঙ্গী বা বন্ধুর দোষ-ত্রুটি, গোপন কথা বা বদনাম মানুষকে বলে বেড়ায়। সঙ্গীর দুর্বলতা নিয়ে তাকে ঘায়েল করার চেষ্টা করে। সোশ্যাল মিডিয়ায় ইঙ্গিতপূর্ণ পোস্ট দিয়ে হাসাহাসির খোরাক তৈরি করে। আর তাদের এই আচরণ থেকে এই বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে যায় যে, সম্পর্কের প্রতি সম্মান দেখানোর চেয়ে, তাদের নিজেদের ক্ষোভ প্রকাশ করাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার পর এই দুই ধরনের আচরণ থেকে বোঝা যায়, কে কতটা সম্পর্কের মূল্য বোঝে। কারণ, একজন প্রকৃত বা সত্যিকারের বন্ধু কখনোই বন্ধুর গোপন বা ব্যক্তিগত দুর্বলতা অন্যের সামনে প্রকাশ করবে না। বন্ধুত্ব ভাঙলেও ভদ্রতা আর সম্মানবোধ অটুট রাখবে। সে যদি তার বন্ধুর ভুল সম্পর্কে কিছু জেনেও থাকে, তবুও অন্য মানুষের সামনে বন্ধুর ভালো গুণটাই বলবে। কারণ, প্রতিটি মানুষের জীবনে ভুল থাকে, আর তার নিকট সেই ভুলের চেয়ে বন্ধুত্ব অনেক বড়।
অপরদিকে সম্পর্ক বা বন্ধুত্ব নষ্ট হওয়ার পরে কেউ যদি অপরপক্ষের ভুলগুলো কিংবা তার দুর্বলতাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে, তাহলে সত্যিকার অর্থে সে কখনো প্রকৃত বন্ধুই ছিল না, ছিল শুধু বন্ধুত্বের ছদ্মবেশে এক ক্ষণিকের অতিথি।
সুতরাং, বন্ধুত্বে যদি সম্পর্ক শেষ হয়েও যায়, তবুও অন্তত সম্মানটুকু টিকে থাকা উচিত। যাতে বন্ধুত্ব হারিয়ে গেলেও, ভদ্রতা, নৈতিকতা আর মানবিকতার শিক্ষা যেন হারিয়ে না যায়।