ছফওয়ান আল মুসাইব

দিল বদল

দিল বদল

মানুষের মন বড়ই অদ্ভুত এক রাজ্য—কখন যে সেখানে ঋতু বদল হয়, তা বলা মুশকিল। যে হৃদয় আজ অভিমানে পাথর, কাল সে-ই আবার ভালোবাসায় আর্দ্র হয়ে ওঠে। মাইমুনা মুন্নির ‘দিল বদল’ উপন্যাসটি ঠিক এই বদলে যাওয়ারই এক জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। এটি এমন এক আখ্যান, যেখানে প্রতিটি চরিত্র নিজের অজান্তেই এক অদৃশ্য সুতোর টানে এগিয়ে চলে—কখনো ভালোবাসার দিকে, কখনো বিশ্বাসের পথে, আবার কখনো বা নিয়তির কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হতে। 

পারিবারিক সংকট, দাম্পত্য জীবনের ভুল বোঝাবুঝি থেকে শুরু করে হেদায়েতের আলোয় উদ্ভাসিত হওয়ার মতো ঘটনার মধ্য দিয়ে লেখিকা দেখিয়েছেন, মানুষের অন্তর আসলে এক বহমান নদী, যা প্রতিনিয়ত তার গতিপথ পরিবর্তন করে। তবে এই হৃদয়স্পর্শী গল্পটি বলার পথে এর নির্মাণশৈলী ও সম্পাদনার কিছু সীমাবদ্ধতাও চোখে পড়ে। সুতরাং আমরা এই রিভিউতে বইটির মূল ভাব, সাহিত্যিক গঠন, চরিত্র, পাঠকপ্রভাব ও সীমাবদ্ধতা—সবদিক থেকেই একটি পরিমিত ও গভীর আলোচনা করার চেষ্টা করব।

মূল বিষয়বস্তু;

কাহিনীর কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে খালিদ, একজন মাদরাসা পড়ুয়া শান্তশিষ্ট যুবক, এবং তার স্ত্রী রাবেয়া। পরিবারের পছন্দে তাদের বিয়ে হলেও, রাবেয়ার অগোচরে এবং অসম্মতিতে এই বিয়ে হওয়ায় শুরুতেই একটি সংকট তৈরি হয়। এই সম্পর্কের টানাপোড়েনের মাঝেই হঠাৎ খালিদের পূর্ব-বিবাহিত প্রথম স্ত্রীর আগমন কাহিনীতে এক নাটকীয় মোড় নিয়ে আসে। খালিদের এই প্রথম বিয়েটি ছিল তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে, একপ্রকার জোরপূর্বক। জীবনের এই জটিলতা, সংকট, ভুল বোঝাবুঝি ও মনস্তাত্ত্বিক টানাপোড়েন কাহিনীকে এগিয়ে নিয়ে যায়।

পরবর্তীতে কাহিনী মোড় নেয় খালিদ এবং রাবেয়ার কন্যা নওশাবার বেড়ে ওঠাকে কেন্দ্র করে। তার ফুফাতো ভাই খুবাইবের সাথে নওশাবার খুনসুটি ও অব্যক্ত ভালোবাসার সম্পর্কের পাশাপাশি, খুবাইবের কথায় অনুপ্রাণিত হয়ে নওশাবার মাদ্রাসার জীবন বেছে নেওয়ার সিদ্ধান্ত তার অন্তরের পরিবর্তন বা ‘দিল বদল’-কে তুলে ধরে।
অতঃপর নওশাবা ও তার বান্ধবী তারান্নুমের মাদরাসা জীবনের বর্ণনার মাধ্যমে লেখিকা ছাত্রীদের দৈনন্দিন জীবন, তাদের পড়াশোনা, বন্ধুত্ব, পারস্পরিক সহযোগিতা এবং দ্বীনের পথে চলার সংগ্রামকে ফুটিয়ে তুলেছেন।

তবে এই উপন্যাসের অন্যতম পয়েন্ট হলো, কট্টর হিন্দু পরিবারের মেয়ে নীলিমার ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার গল্প। খুবাইবের অপ্রত্যাশিত সাহায্য ও তার সৎ চরিত্র নীলিমার মনে ইসলাম সম্পর্কে জানার আগ্রহ তৈরি করে। পরবর্তীতে নওশাবার সংস্পর্শে এসে এবং ইসলামের সৌন্দর্য উপলব্ধি করে সে ইসলাম গ্রহণ করে ‘মাইমুনা’ নামটি বেছে নেয়।

উপন্যাসের শেষভাগে এসে কাহিনী দ্রুত এগিয়ে যায় এবং একটি আবেগঘন ও বিয়োগান্তক মোড় নেয়। খুবাইব-নওশাবার বিয়ের পর তারা নওমুসলিম মাইমুনার (নীলিমা) কাছ থেকে একটি চিঠি পায়। চিঠিতে মাইমুনা তার অসুস্থতার কথা এবং তার জীবনের শেষ ইচ্ছা জানায়। চিঠি পেয়ে তারা কালবিলম্ব না করে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়, কিন্তু সেখানে পৌঁছে তারা জানতে পারে যে, মাইমুনা আর বেঁচে নেই ।
মাইমুনার জানাজা সম্পন্ন করে বাড়ি ফেরার পথে, তাদের গাড়িটিকে পেছন থেকে একটি ট্রাক সজোরে ধাক্কা মারে। এই ভয়াবহ দুর্ঘটনায় খুবাইব মৃত্যুবরণ করে। মৃত্যুর পর খুবাইবের ছোট ভাই হানজালার সাথে নওশাবার দ্বিতীয় বিবাহ হয়। এভাবেই এক বিয়োগান্তক ঘটনার মধ্য দিয়ে গল্পটি একটি নতুন সূচনার ইঙ্গিত দিয়ে শেষ হয়। 

পাঠ প্রতিক্রিয়া;

‘দিল বদল’ উপন্যাসটি পড়ার পর একজন মনোযোগী পাঠকের মনে প্রশংসা ও অতৃপ্তি—উভয়েরই জন্ম হতে পারে। কারণ….?

    • বার্তাবহন ও অনুপ্রেরণা: বইটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হল এর মেসেজ। লেখিকা গল্পে গল্পে ইসলামি জীবনব্যবস্থার সৌন্দর্য, হেদায়েতের গুরুত্ব, পর্দা, হালাল-হারাম সম্পর্ক, আল্লাহর উপর ভরসা এবং দ্বীনি শিক্ষার গুরুত্ব বিষয়গুলো অত্যন্ত সহজভাবে তুলে ধরেছেন। তিনি অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে বোঝাতে চেয়েছেন যে, মানুষ চাইলে বদলাতে পারে এবং আল্লাহ চাইলে যে কাউকে সঠিক পথ দেখাতে পারেন। বিশেষ করে, নীলিমার ইসলাম গ্রহণের গল্পটি খুব সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, যা পাঠকের মনে গভীর ছাপ ফেলে। সুতরাং বলা যায়, লেখিকার উদ্দেশ্য যদি হয় এই বইটির মাধ্যমে সমাজে মেসেজ দেওয়া, তাহলে সেদিক থেকে নিঃসন্দেহে তিনি অনেকটাই সফল।
    • সাহিত্যিক গঠন ও কেন্দ্রীয় চরিত্র: বইটি পড়তে গিয়ে আমার বারবার মনে হয়েছে, এই উপন্যাসের ঠিক মূল চরিত্র কে? একটা উপন্যাসের সবচেয়ে বড় কাঠামোগত দুর্বলতা হলো এর কেন্দ্রচ্যুতি। কাহিনী খালিদকে দিয়ে শুরু হলেও দ্রুতই ফোকাস সরে গিয়ে নওশাবা, নীলিমা, এমনকি তারান্নুমের ওপর পড়ে। সাহিত্যিক ধারার বিচারে, একটি ধ্রুপদী উপন্যাসে সাধারণত একজন বা দু’জন মূল চরিত্র থাকে। তবে একাধিক কেন্দ্রীয় চরিত্র থাকাটা আধুনিক সাহিত্যে নতুন নয়, কিন্তু এক্ষেত্রে এই বইটিতে ক্যারেক্টার গুলোর যথাযথ পূর্ণ রূপ এবং তাদের কাহিনীর যৌক্তিক সমাপ্তি ঘটেনি। এর ফলে পাঠকের মনোযোগকে বিক্ষিপ্ত করতে পারে। 
    • অমীমাংসিত অধ্যায়; একটি ভালো বইয়ের অন্যতম শর্ত হলো তার বৃত্ত সম্পূর্ণ করা। কিন্তু ‘দিল বদল’-এ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন অমীমাংসিত থেকে যায়। তারান্নুমের পারিবারিক সংকট ও তার বিয়ে শেষ পরিণতি কী হলো, তা আর জানা যায় না। খালিদের মোবাইলে অচেনা নাম্বার থেকে আসা ‘‘সময় মত বুঝে নিবো সব পাওনা’’ মেসেজ, তার চাচা রুস্তম আলীর ষড়যন্ত্রের শেষ কোথায়, তাও অস্পষ্ট। এ ধরনের অমীমাংসিত অধ্যায়গুলো পাঠক হিসেবে এক ধরনের অতৃপ্তি তৈরি করে।
    • চরিত্রের মনস্তাত্ত্বিক শূন্যতা: কিছু কিছু জায়গায় এই বইয়ের ক্যারেক্টারগুলো একেবারেই সাদাকালো। তাদের সিদ্ধান্তের পেছনের মনস্তাত্ত্বিক দ্বিধাদ্বন্দ্বের গভীরতা অনুপস্থিত। খালিদের চরিত্রটি এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ। সে একজন ধার্মিক যুবক, অথচ সে তার প্রথম স্ত্রীকে ভয় দেখিয়ে তাড়িয়ে দেওয়ার জন্য নদীতে নিয়ে যাওয়ার মতো একটি ভয়ংকর পরিকল্পনা করে। বিবাহ ইচ্ছাকৃতভাবে হোক বা অনিচ্ছাকৃতভাবে হোক, সে তার স্ত্রী। তবে যাই হোক, পরবর্তীতে খালিদ কিডন্যাপ হওয়ার পরে জানা যায়, সে মেয়েটির অন্য আরেক জায়গায় বিবাহ হয়েছে এবং তার একটি বাচ্চাও আছে। কিন্তু পুরো বইটিতে তাদের ডিভোর্স ইত্যাদি নিয়ে কোন আলোচনা হয়নি। যা খুবই….!
    • গতির অসামঞ্জস্য: খালিদের দ্বিতীয় স্ত্রীর সাথে সম্পর্কের টানাপোড়েন এবং তার আকস্মিক তাবলিগে চলে যাওয়া, কিডন্যাপের ঘটনাগুলো খুবই দ্রুত বর্ণনা করা হয়েছে। অন্যদিকে, মাদরাসার জীবনের কিছু সাধারণ ঘটনা (যেমন—ছাত্রীদের ছাদে যাওয়া, বৃহস্পতিবারের পরিচ্ছন্নতা অভিযান, তারান্নুমের মাদ্রাসা যাতায়াত, ইত্যাদি) বেশ বিস্তারিতভাবে এসেছে। এই অসামঞ্জস্য বই পড়ার সাবলীল গতিকে বাধাগ্রস্ত করে।
    • প্রচ্ছদ, বিন্যাস ও সম্পাদনা: একটি বইয়ের প্রথম আকর্ষণ হচ্ছে তার প্রচ্ছদ, যা এই বইটির ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছে বলে আমি মনে করি। এর চেয়েও গুরুতর বিষয় হলো সম্পাদনা ও বিন্যাসের ঘাটতি। পুরো বই জুড়ে Typesetting Error বা Punctuation Spacing Error মতো ‘বিন্যাসগত ত্রুটি’ বারংবার ঘটেছে। এটা শুধু দেখতে চোখে বাজে লাগে বিষয়টা তা নয়, বরং পড়ার সাবলীল গতিকেও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে, যা একটি মানসম্মত প্রকাশনার পরিচায়ক নয়। এই দিকগুলোতে আরও মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন ছিল।

চূড়ান্ত মন্তব্য;

‘দিল বদল’ এমন একটি বই যার মূল্যায়ন আপনার দৃষ্টিভঙ্গির ওপর নির্ভর করে।

  • আপনি যদি ইসলামি মূল্যবোধের আলোকে লেখা একটি সহজ, অনুপ্রেরণামূলক এবং হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া বই খুঁজে থাকেন—যেখানে বার্তাটা গল্পের শৈলীকে ছাড়িয়ে যায়, তবে এই বইটি আপনার ভালো লাগবে। 
  • কিন্তু আপনি যদি একটি সুগঠিত, সাহিত্যরস সমৃদ্ধ, মনস্তাত্ত্বিকভাবে গভীর, নিঁখুত সম্পাদনা এবং টানটান উত্তেজনার উপন্যাস আশা করেন, তবে বইটি আপনাকে হতাশ করবে।

তাই সংখ্যায় রেটিং না দিয়ে, এর ভালো দিক আর সীমাবদ্ধতাগুলো আলাদা করে বলাটাই বেশি যুক্তিসঙ্গত হবে বলে আমি মনে করেছি। তবে পুরো বইটি জুড়ে লেখিকা এক মহৎ বার্তা দেওয়ার আন্তরিক চেষ্টা চালিয়ে গেছেন, কিন্তু লেখার গড়নে কিছু ঘাটতি থাকায় সেটা পরিপক্ক ভাবে জ্বলে উঠতে পারেনি। তবে যেহেতু লেখিকা হিসেবে ‘মাইমুনা মুন্নির’ এটি প্রথম প্রকাশিত বই— সুতরাং, কিছু সীমাবদ্ধতা থাকা স্বাভাবিক এবং প্রথম প্রচেষ্টা হিসেবে এটি নিঃসন্দেহে প্রশংসার যোগ্য। আশা করি, ভবিষ্যতে তিনি আরও গভীরতা ও নান্দনিকতায় ভরপুর লেখা নিয়ে পাঠকের মাঝে নিজস্ব স্বরকে আরও শক্তভাবে তুলে ধরবেন।

লেখিকার সংক্ষিপ্ত জীবনী;

লেখিকা মাইমুনা মুন্নির জন্ম শরীয়তপুরে। তিনি মুন্সিগঞ্জের খলাপাড়ার ‘‘জামিয়া ইসলামিয়া আদর্শ মহিলা মাদরাসা’’ থেকে দাওরায়ে হাদিস (মাস্টার্স) সম্পন্ন করেন। বই পড়ার প্রতি তাঁর ছোটবেলার প্রবল আগ্রহই তাঁকে লেখালেখির জগতে নিয়ে আসে। ‘দিল বদল’ তাঁর প্রকাশিত প্রথম বই এবং তিনি আদর্শ সমাজ বিনির্মাণের স্বপ্ন থেকেই লেখালেখি করেন।

বইয়ের নাম: দিল বদল
লেখিকা: মাইমুনা মুন্নি
প্রকাশনী: আল হিবা পাবলিকেশন
মূল্য: ১৬৫ ৳

বইটি সংগ্রহ করতে চাইলে আপনার নিকটস্থ লাইব্রেরিতে খোঁজ নিতে পারেন। এছাড়া, দেশের অন্যতম অনলাইন বুকশপ ওয়াফিলাইফ-সহ বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্মেও বইটি পাওয়া যাচ্ছে। সর্বশেষ অফার সম্পর্কে জানতে বা সংগ্রহ করতে লিংকে ক্লিক করুন: https://www.wafilife.com/dil-bodol/dp/1197922

আমার সম্পর্কে

আমি ছফওয়ান আল মুসাইব, একজন 3D আর্টিস্ট, ভিডিও এডিটর। 3D আর্টের প্রতি গভীর ভালোবাসা থেকেই আমি আমার ক্যারিয়ার শুরু করি, এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজের দক্ষতা গড়ে তুলেছি। পেশাগত জীবনে সাফল্যের পাশাপাশি আমি গল্প লেখা এবং ভ্রমণে দারুণ আগ্রহী। শখের বসে মাঝে মাঝে হাতে কলম তুলে নিই এবং আমার মনের ভাবনা ও অনুভূতিগুলোকে শব্দে রূপ দিই। আমার লেখা গল্পগুলো বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছে, যা অনেক পাঠকের হৃদয় ছুঁয়ে গেছে।

জনপ্রিয় পোস্ট

সাম্প্রতিক পোস্ট