ছফওয়ান আল মুসাইব

জীবনের যাঁতাকল

জীবনের যাঁতাকল

রুহুল শুয়ে আছে নিজের ছোট্ট ঘরে। দিনের পর দিন হাড়ভাঙা পরিশ্রমে তার শরীর যেন পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে। প্রতিদিন একই রকম ক্লান্তি নিয়ে বাড়ি ফিরে এসে বিছানায় শোবার পরও ঘুম আসে না। আজও সেই একই দশা। রাতের নীরবতা তাকে আরও বেশি করে নিজের ভেতরের কষ্টগুলো অনুভব করিয়ে দেয়। বাইরে থেকে বৃষ্টি পড়ার মৃদু শব্দ আসছে, কিন্তু তার মনের ভেতর যেন অঝোরে ঝড় বয়ে চলেছে। চোখ বন্ধ করলেই নানা চিন্তা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খায়—কীভাবে চলবে আগামীকাল, কীভাবে চলবে তার পরিবারের ভবিষ্যৎ?

আজ বিকালে বাজারে গিয়েছিল সে, হাতে গোনা কয়েকটা টাকা নিয়ে। বাজারের প্রতিটি জিনিসের দাম যেন আকাশ ছুঁয়েছে। পরিবারের জন্য সামান্য কিছু চাল, ডাল, আর সবজি কেনা ছাড়া আর কিছুই কেনা সম্ভব হয়নি। তার স্ত্রীর মুখে সবসময় একটাই কথা—“বাচ্চাদের জন্য একটু ভালো খাবার এনে দাও, তাদের শরীর ভালো নেই।” কিন্তু রুহুল জানে, তার আয় এতটাই সীমিত এবং বাজারের প্রতিটি জিনিসের যে আকাশ ছোয়া দাম, তাতে দু’বেলা খাবার জোগাড় করাই এখন কঠিন হয়ে পড়েছে।

রুহুল ছোটবেলা থেকেই সংগ্রামী জীবনযাপন করে আসছে। পাড়ার সরকারি স্কুলে পড়াশোনা করেছিল, যেখানে প্রাথমিক স্তরে তার সাফল্য চোখে পড়ার মতো ছিল। শিক্ষকরা তাকে নিয়ে আশাবাদী ছিলেন, তার মেধা ও চেষ্টার জন্য। কিন্তু যখন উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন দেখার সময় এলো, তখনই তার জীবনে এসে পড়ে অন্ধকারের ছায়া। তার বাবা অসুস্থ হয়ে যায় আর সংসারের দায়িত্বের ভারও তার কাঁধে এসে পড়ে।

বাবার মৃত্যুর পর রুহুলের মনে একটাই চিন্তা ঘুরপাক খেতে থাকে—কিভাবে পরিবারকে টিকিয়ে যায়? সাথে তার স্বপ্নগুলো ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে থাকে। মনে তখন উদ্দীপনা ছিল, একদিন সমাজের কাছে একজন ভালো মানুষ হিসেবে পরিচিত হবে। এমনকি বড় হয়ে সবার সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর ইচ্ছে ছিল। কিন্তু বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। সংসারের চাপে, দারিদ্র্যের অভিশাপে সমস্ত স্বপ্ন যেন একে একে ভেঙে পড়তে শুরু করে।

বর্তমান রুহুলের তিনটি সন্তান। বাবা হিসেবে প্রতিটি সন্তানকে বড় করে তোলার দায়িত্বও তার ওপর। তাদের পড়াশোনার খরচ, বই, ইউনিফর্ম—সবকিছু মিলিয়ে একটি বিশাল বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংসারের দৈনন্দিন খরচের সঙ্গে সবকিছু জুড়ে দিতে গেলে, কোনোভাবেই কিছুই ঠিক মত জোটানো সম্ভব হচ্ছে না। খাবার, পোশাক, এবং চিকিৎসার মতো মৌলিক প্রয়োজনীয়তাও পূরণ করতে হিমশিম খাচ্ছে সে। এসব নিয়ে ভেবেই রাতে তার ঘুম আসছে না। তার সন্তানেরা যখন বড় হবে, তখন হয়তো তারাও তার মতোই এই সমাজের অন্ধকারে হারিয়ে যাবে। সে চোখ বন্ধ করলেই, এইসব দৃশ্য তার চোখে ভাসে। 

মাঝেমধ্যে তার মনে হয়, এই সমাজটা গরিবদের জন্য নয়। চারপাশে তাকালে দেখতে পায়, ধনীরা আরো ধনী হয়ে উঠছে, আর গরিবরা যেন ক্রমশ নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। তাদের জীবন সংগ্রামের মাঝে কোনো প্রকার উন্নতি নেই। গ্রামে যা ঘটে, তা যেন এক বৈপরীত্য। বড় বড় লোকেরা তাদের স্বার্থে ধন-সম্পদ, জমি-জায়গা কিনে নিচ্ছে, আর সাধারণ মানুষেরা তাদের ভূমি হারিয়ে যাচ্ছে। তারা নিজেদের মুনাফার জন্য সবকিছু সামলাচ্ছে, কিন্তু রুহুলের মতো কৃষকদের জন্য কিছুই নেই।

গ্রামের মাঠে চাষবাস করতে গিয়ে রুহুল প্রতিদিন চরম পরিশ্রম করে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ক্ষেতে কাজ করতে হয়। কিন্তু সব শ্রমের ফল নিয়ে যখন বাড়ি ফেরে, তখন তার হাতের মুঠোতে থাকে শুধু অসীম কষ্ট। অথচ, গ্রামে চারপাশে দেখা যায়, বড়লোকেরা জমির টাকায় আরো বড়লোক হচ্ছে, আরো সম্পদ গড়তেছে। আর তার মতো গরিব কৃষকেরা দিনরাত হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে একবেলা খাবার জোগাড় করতে হিমশিম খাচ্ছে।

বিকালে সে বাজার থেকে ফেরার পথে সূর্য ডোবার আগে রোদে মাথা উঁচু করে হাঁটছিল। প্রতিদিনের মতো আজও তার কাঁধে ছিলো পরিশ্রমের বোঝা। বাড়ির কাছাকাছি আসতেই হঠাৎ করে সামনে এসে দাঁড়ালো তার ছোট ছেলে রাসেল। শিশুটির মুখে ছিল এক আশাবাদী হাসি, যেন সে কোনো আনন্দের খবর শোনার অপেক্ষায় ছিল। উদ্দীপনার সঙ্গে রাসেল বললো, “বাবা, তুমি কি আজ আমার জন্য মজা এনেছো? নাকি আজকেও আনো নি?”

রুহুলের মুখ থেকে কোনো কথা বের হলো না। ছেলের মুখের সেই আনন্দময় প্রশ্ন শুনে তার হৃদয়ে যেন এক কষ্টের তরঙ্গ আছড়ে পড়লো। নিঃশব্দে মাথা নত করে, সে শুধু রাসেলের দিকে তাকালো। রাসেলের ভ্রান্ত বিশ্বাস আর প্রত্যাশা, যেন তার হৃদয়কে আঘাত করলো। চোখের কোণে অশ্রু জমতে লাগলো—সমাজের কঠোর বাস্তবতা ক্রমাগত তার ভেতর থেকে শক্তি নিয়ে নিচ্ছিল।

রাতে শুয়ে শুয়ে তার মনে এক গভীর প্রার্থনা ভিড় করে। তার সন্তানরা একদিন যেন এই কঠোর সমাজের চক্র থেকে বেরিয়ে এসে নিজেদের জন্য একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ তৈরি করতে পারে। তাদের যেন শিক্ষার আলো, সুযোগের দরজা খুলে যায়। যেন তারা তার মতো দারিদ্র্যের পাঁজরে আটকে না পড়ে, বরং একটি উজ্জ্বল জীবন গড়ে তুলতে পারে। তারা যেন ভবিষ্যতের আলোতে তাদের পথ খুঁজে নিতে পারে, যাতে সমাজের বৈষম্য তাদের স্বপ্নের মধ্যে বাধা সৃষ্টি করতে না পারে। 

আমার সম্পর্কে

আমি ছফওয়ান আল মুসাইব, একজন 3D আর্টিস্ট, ভিডিও এডিটর। 3D আর্টের প্রতি গভীর ভালোবাসা থেকেই আমি আমার ক্যারিয়ার শুরু করি, এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজের দক্ষতা গড়ে তুলেছি। পেশাগত জীবনে সাফল্যের পাশাপাশি আমি গল্প লেখা এবং ভ্রমণে দারুণ আগ্রহী। শখের বসে মাঝে মাঝে হাতে কলম তুলে নিই এবং আমার মনের ভাবনা ও অনুভূতিগুলোকে শব্দে রূপ দিই। আমার লেখা গল্পগুলো বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছে, যা অনেক পাঠকের হৃদয় ছুঁয়ে গেছে।

জনপ্রিয় পোস্ট

সাম্প্রতিক পোস্ট