বিকালের মলিন আলো ক্রমশ মিলিয়ে আকাশের রঙ যেন ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হচ্ছে। এক নৈসর্গিক রূপান্তরের মাঝে মনে হচ্ছে, বুঝি সন্ধ্যা নেমে এসেছে। কিন্তু ধারণা ভুল। সন্ধ্যা নয়, বরং ভরদুপুরে আকাশজুড়ে জমাট বেঁধেছে কালো মেঘ। সেই মেঘগুলো একের পর এক দখল নিচ্ছে আকাশের প্রতিটি কোণ। চারপাশে থমথমে পরিবেশের মধ্যে হঠাৎ শুরু হলো দমকা হাওয়া, যার শনশন শব্দে চারদিক কেঁপে উঠল। গাছের শুকনো ডালপালা ভেঙে পড়তে লাগল সশব্দে, আর তার সাথে তাল মিলিয়ে শুরু হল ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। আকাশের বুক চিরে ঝরতে থাকা সেই জল যেন তৃষ্ণার্ত নগরবাসীর আত্মাকে তৃপ্তি দিল। যেন প্রকৃতি নিজ হাতে সিক্ত করছে চারপাশকে, আর সবকিছু ধুয়ে মুছে সজীব করে তুলছে।
নিশাদ ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভেজা প্রকৃতির এই অপূর্ব দৃশ্য দেখছে। গাছের ডালপালা উত্তাল হাওয়ায় দুলছে, আর চারপাশের পরিবেশ এক অদ্ভুত প্রশান্তির সাথে মিলেমিশে যাচ্ছে। বাহিরের প্রকৃতি যেমন উত্তাল, নিশাদের মনও তেমনি আজ তোলপাড় করা কষ্টে আচ্ছন্ন। তার মনের গভীরে যেন এক তীব্র বেদনার ঝড় বয়ে যাচ্ছে, যা সবকিছু তছনছ করে দিয়ে যাচ্ছে।
এমন এক বৃষ্টিভেজা দিনে, সীতাকুণ্ড রেলস্টেশন থেকে কিছুটা দূরে এক বয়স্ক ব্যক্তি ব্রেইন স্ট্রোক করে রাস্তায় পড়ে ছিল। নিশাদ তখন ঢাকার কর্মব্যস্ত জীবন থেকে কিছুদিনের ছুটি নিয়ে সীতাকুণ্ড ভ্রমণে গিয়েছিল। সেদিনের বৃষ্টি আর ঝড়ের মধ্যে রাস্তায় পড়ে থাকা মানুষটিকে দেখে, সে আরেকজন মেয়ের সাহায্যে তৎক্ষণাৎ লোকটিকে কাছের হাসপাতালে নিয়ে যায়। তবে বৃদ্ধ ব্যক্তির শারীরিক অবস্থা খুবই আশঙ্কাজনক ছিল, আর পরিবারও আর্থিকভাবে যথেষ্ট দুর্বল ছিল। লোকটির পরিবারের দুর্দশা দেখে নিশাদ সেই বৃদ্ধের চিকিৎসার সকল খরচ বহন করে। অনেকদিন ধরে চলা চিকিৎসার পর লোকটির শারীরিক অবস্থা ধীরে ধীরে স্বভাবিক হয়ে উঠে।
এই ঘটনাই হয়ে দাঁড়াল এক নতুন সম্পর্কের সূচনা। সেই মেয়েটি, যে সেদিন রাস্তায় বৃদ্ধকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য নিশাদের সাহায্য করেছিল, সেখান থেকেই ওই মেয়েটির মনে জন্ম নেয় নিশাদের প্রতি এক পৃথিবী কৃতজ্ঞতা এবং ভালোবাসা। একসময় তাদের মধ্যে সু-সম্পর্ক গড়ে ওঠে, যা পরিণত হয় বিবাহের বন্ধনে।
তবে গত একদিন আগের একটি ছোট্ট ঘটনার কারণেই নিশাদের মনের ভেতরে কষ্টের দমকা হাওয়া বইছে। সেদিন অফিস বন্ধ থাকায় নিশাদ দুপুরের খাবার খেয়ে একটু বিশ্রাম নিতে চেয়েছিল। হঠাৎ তার বস ফোন করে একটি কাজের ফাইল সময় মতো জমা না দেওয়ার জন্য তাকে কঠোরভাবে তিরস্কার করতে থাকে। ঠিক এমন সময় অধরা (নিশাদের স্ত্রী), দুষ্টুমি করে মোবাইলটি তার হাত থেকে টেনে নেয়। রাগ সামলাতে না পেরে, নিশাদ অধরার গালে একটি জোরালো থাপ্পড় বসিয়ে দেয়। অধরা হতবাক হয়ে বিছানার একপাশে বসে কাঁদতে থাকে, আর নিশাদ রাগে ফুঁসে বাসা থেকে বের হয়ে যায়।
রাত ঠিক বারোটা বাজে। নিশাদ তখনও বাসায় ফেরেনি, এদিকে অধরার মন নানা দুশ্চিন্তায় ভারী হয়ে উঠেছে। দুপুরের সেই তিক্ত মুহূর্তের পর রাগ করে বাসা থেকে বেরিয়ে গিয়েছে নিশাদ, তারপর থেকে আর তার কোনো খোঁজ নেই। বিবাহিত জীবনের এই প্রায় দেড় বছরে এমন ঘটনা অধরা কখনোই প্রত্যক্ষ করেনি। নিশাদ কখনো এভাবে রেগে বেরিয়ে যায়নি। আর তাছাড়া সাধারণত রাত ৭টার আগে অফিসের কাজ শেষ করে বাসায় ফেরে সে। আর আজ তো ছুটির দিন—এমন দিনে বিকালে বন্ধুদের সাথে একটু আড্ডা দিয়ে সন্ধার পূর্বেই সে বাসায় ফিরে আসে।
অধরা বারবার চেষ্টা করছে নিশাদের সাথে যোগাযোগ করার। কিন্তু নিশাদ কিছুতেই ফোন রিসিভ করে না। অধরার মনের ভেতর এক অজানা আতঙ্ক আর দুশ্চিন্তার মেঘ ঘনীভূত হতে থাকে। মাথায় নানান চিন্তা এসে বাসা বাধতে থাকে। আর দুপুরের সেই পরিস্থিতি তাকে আরো অসহায় বোধ করে তুলছিলো। রাগ, কষ্ট, আর উদ্বেগ মিলিয়ে অধরার মন যেন ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছিল। সে কিছুতেই সহ্য করতে পারছিল না নিশাদের এমন আচরণ। যে মানুষটা প্রতিদিন সন্ধ্যার আগে বাসায় ফিরে, তার এতটা দেরি করা মেনে নিতে পারছিল না সে। আশঙ্কা, অভিমান আর উৎকণ্ঠায় অধরার বুকটা যেন ফেটে যাচ্ছিল। লাইট বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে সে চুপচাপ কান্না করতে লাগল। প্রতিটা চোখের জলে যেন তার ভেতরের সমস্ত কষ্ট ঢেলে দিচ্ছিল।
প্রায় রাত দুইটার দিকে গেট খোলার শব্দ পেয়ে অধরা তড়িঘড়ি করে মাথা তুলে তাকায়। নিশাদ ঘরে ঢুকেছে। তবে অধরা রাগে গুম হয়ে থাকে, মুখ থেকে একটি শব্দও বের হয় না। তার মনের ভেতরে এক ধরনের শক্ত সিদ্ধান্ত_ সে নিজে থেকে কিছুতেই কথা বলবে না। ঘুমের ভান করে চুপচাপ শুয়ে রইল, যেন নিশাদের দেরি করে ফেরা তাকে মোটেও বিচলিত করেনি। কারণ অধরা জানে, নিশাদ এখন তার রাগ ভাঙানোর জন্য নানা পাগলামি করবে। বিয়ের পর কয়েকবার টুকটাক কথা কাটাকাটি হয়ে এমন মনোমালিন্য হয়েছে তাদের। প্রতিবারই অধরা রাগ করে চুপ থাকে, আর নিশাদ সেই রাগ ভাঙানোর জন্য অদ্ভুত সব হাস্যকর কাজ করে। অধরার দিকে হাসি মাখা মুখে তাকিয়ে থাকে, তাকে নানাভাবে আদর করে, মিষ্টি কথায় বুঝিয়ে নিজের ভুল স্বীকার করে। অধরার এই ভেতরের অভিমান তখন বরফের মতো গলে যায়। নিশাদের সেই ছোট ছোট পাগলামিগুলো তাকে এতটাই দুর্বল করে ফেলে যে, সে শেষ পর্যন্ত আর রাগ করে থাকতে পারে না।
কিন্তু আজকের রাতটা যেন আলাদা। নিশাদ চুপচাপ এসে বিছানায় শুয়ে পড়ল, কোনো কথা বলল না। এমনকি রাগ ভাঙানোর চেষ্টাও করল না। তার ঠান্ডা, নির্লিপ্ত আচরণে অধরার মনের অস্বস্তি যেন আরও বেড়ে গেল। সে ভেবেছিল, কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেই নিশাদ এসে তার কাছে বসবে, হয়তো ধীরে ধীরে হাতটা ধরে মৃদু স্বরে বলবে_ ‘অধরা, রাগ করো না, প্লিজ। আমি ভুল করেছি, মানছি।’ কিন্তু নিশাদের ব্যবহারে সেদিন বেশ অবাক হয় অধরা। কোন সাড়া শব্দ নেই, চুপ করে বিছানায় এসে অন্যদিকে মুখ করে শুয়ে পরে নিশাদ। এভাবে কিছুক্ষণ যাওয়ার পর, অধরা অধৈর্য হয়ে লাইট জ্বালিয়ে নিশাদের সামনে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করে_ এত দেরি করে কেন বাসায় ফিরলে, কোথায় ছিলে এত রাত পর্যন্ত ? নিশাদ কপাল থেকে হাতটা সরিয়ে এক নজর অধরা দিকে তাকিয়ে, আবার চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকে।
– কি হলো, কথা বলছো না কেন?
– অধরা চুপ করো! শরীরটা ভালো না, ক্লান্ত লাগছে। তোমার এসব ফালতু প্রশ্ন এই মুহুর্তে আমার কাছে বিরক্তিকর মনে হচ্ছে। উত্তর দেওয়ার মতো কোন মুড নাই। অনেক রাত হয়েছে শুয়ে পরো। সকালে উঠতে হবে, অফিস আছে আমার।
– এখন তো বিরক্ত লাগবেই। প্রাপ্তি শেষে এখন আর সেই ভালোলাগা নেই। তাই ভালোবাসার মানুষটির অতিরিক্ত ভালোবাসাও এখন বিরক্তিকর মনে হবে। আর তুমি কথা বলতে না চাইলেই কি সবকিছু বন্ধ হয়ে যাবে? কি ভাবছো তুমি নিজেকে? আমি আর এক মুহূর্তও এই বাসায় থাকতে চাইনা।
অধরা ব্যাগ গোছাতে লাগলো। নিশাদ অধরাকে বললো_ বাড়াবাড়ি করো না কিন্তু এখন। তাহলে তোমার উপর আবার হাত উঠে যাবে।
– হ্যাঁ, তুলো হাত! তুলবা না কেন? যত যা কিছুই করো আমি আর এই বাসায় থাকবে না। যেখানে আমার কথার কোন মূল্য নাই, আমার আহ্লাদের কোন দাম নাই, সেখানে থাকার থেকে না থাকাই ভালো।
অধরা ব্যাগ গুছিয়ে যখন রুম থেকে বের হতে যায়, নিশাদ তখন রাগ সামলাতে না পেরে অধরার গালে আবার একটা থাপ্পর বসিয়ে দেয়।
– রাত দু’টা বাজে! এই সময় তুমি বাসা থেকে বেরিয়ে যাচ্ছ? এত সাহস তোমার? যদি যেতে হয়, সকালে যাবে। আর সবকিছু একেবারে নিয়ে যাবে। আমি ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দেব। কোনো দিনও এই বাসায় আসা লাগবে না। _এ কথা বলে নিশাদ দরজা লক করে শুয়ে পড়ল। অধরা দরজার এক পাশে বসে আবার কাঁদতে শুরু করল।
সকালে নিশাদের ঘুম ভাঙতেই সে দেখে অধরা দরজার পাশের দেয়ালের সঙ্গে মাথা ঠেকিয়ে বসে বসে ঘুমাচ্ছে। অধরার এই অসহায় অবস্থাটা দেখে নিশাদের মনে গভীর কষ্ট অনুভব হয়। গতকাল অধরার গায়ে হাত তোলা একদমই ঠিক হয়নি। খুব ইচ্ছে হচ্ছিল, অধরার কপালে একটা চুমু দিয়ে মাফ চাওয়া। কিন্তু কিছু একটা মনে করে সে চুপসে যায়।
অতঃপর নিশাদ অফিসের উদ্দেশ্যে রেডি হয়ে আস্তে করে টেবিলের উপর থেকে ঘড়িটা হাতে পরে বেড রুম থেকে বের হয়, নিঃশব্দ ভাবে। যেন কোন শব্দ না হয়। তার একমাত্র লক্ষ্য_ অধরা যেন জেগে না ওঠে। ডাইনিং রুমে খাবার টেবিলের উপর রাখা জগ থেকে এক গ্লাস পানি খেয়ে অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে সে।
দুধওয়ালা চাচার কলিং বেলের শব্দে ঘুম ভাঙ্গে অধরার। বিছানায় তাকিয়ে দেখে নিশাদ নেই, ঘড়িটাও নেই। তার মানে অফিস চলে গেছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে ৯:২০ বাজে। ফ্রেশ হয়ে এক কাপ কফি বানিয়ে সোফায় বসে বসে গত দিনের সব কিছু ইমাজিন করতে থাকে সে! ডিভোর্স লেটারের কথা মনে পড়তেই তার বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠে। ‘এই কি সেই, যে বিবাহের প্রথম রাতে আমাকে ভালোবাসি বলে জড়িয়ে ধরে বলেছিল_ আমার কথা নাকি এত্তো এত্তো মিষ্টি যে, আমার মুখের কথা শুনে শুনে চিনি ছাড়াও কফি খাওয়া সম্ভব। আর এখন আমার বলা কথা তার কাছে বিরক্তকর মনে হয়! তাহলে কি ধরে নিব, এসব কিছু ওর ভালোবাসা ছিলো না! শারীরিক চাহিদা ছিল মাত্র। যাকে ভালোবাসা বলে চালিয়ে দিয়েছে।
নাহ! এই বাসায় আর এক মুহূর্ত থাকা যাবে না। যার কাছে আমার কথার কোন মূল্য নেই, আমার চোখের পানির কোন দাম নেই, আমার আবদার-আহ্লাদের কোন কদর নেই, নেই আমার অভিমানের কোন মূল্যায়ন। এই মৃত্যুপুরীতে তার সঙ্গে থাকার থেকে না থাকাই ভালো।’
নিশাদ অফিসে কাজ করছিল ঠিকই, কিন্তু তার মন যে একদম কাজে নেই, তা তার বন্ধু আকাশের বিষয়টা বুঝতে বাকি রইলো না। হাতের কাজ গুলো শেষ করে নিশাদের কাছে গিয়ে বসে সে জিজ্ঞেস করলো_ কি রে, কি হয়েছে তোর? এমন ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে কেন?
– অধরার সাথে কাল আমার ঝগড়া হয়েছে। দুইবার হাতও তুলেছি ওর উপর। গতকাল দুপুরে বস ফোন দিয়েছিল। সাজিদ গ্রুপের ওই ফাইলের জন্য বকাবকি করেছিল। ফোনে কথা বলা অবস্থায়, অধরা দুষ্টামি করে ফোনটা আমার হাত থেকে টান দেয়। আর বসের উপরে রাগ গিয়ে পরে ওর উপর।
– চিন্তা করিস না, সব ঠিক হয়ে যাবে। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া, মনোমালিন্য হয়েই থাকে। বাসায় গিয়ে ভাবির সাথে সব ঝামেলা মিটিয়ে নিবি। চল একটু বাইরে গিয়ে চা খেয়ে আসি, দেখবি ভাল লাগবে।
নিশাদও মনে মনে ঠিক করলো, সন্ধায় বাসায় ফিরে অধরার কাছে ক্ষমা চেয়ে নেবে। অধরার সাথে ঝামেলা হওয়ায় কোন কিছুতেই যে মন বসছে না তার।
বিকাল পাঁচটার দিকে নিশাদের হোয়াটসঅ্যাপে অধরার নাম্বার থেকে একটা মেসেজ আসে। মেসেজটা সিন করতেই যেন নিশাদের দম বন্ধ হয়ে আসছিল। মেসেজে ছোট্ট করে লেখা_ ‘আমি চলে এসেছি, ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দিও। আমি সাইন করে দিব।’ মেসেজটা পাওয়ার পর নিশাদ অধরার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে, কিন্তু অধরার ফোন বার বার সুইচ অফ বলে। নিশাদ মনে মনে ভাবে_ ‘অধরা ফাজলামি করে মজা করছে না তো? নাকি সত্যি সে তার বাবার বাড়ি চলে গেছে?’ গত কালকে অধরার গায়ে হাত তোলা অতঃপর তার অভিমান না ভাঙ্গানো এবং নিজের বলা কথার উপর খুব আফসোস হতে লাগে তার।
নিশাদ বাসায় এসে দেখে দরজা বাহির থেকে লক করা। তার মানে অধরা সত্যি চলে গেছে। নিশাদ ভাবতেও পারেনি অধরা এমনটা করবে। নিশাদ ডুবলিকেট চাবি দিয়ে বাসার দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করে। রুমগুলো অন্ধকার। লাইট জ্বালানোর সাহস হচ্ছিল না তার। কিছুক্ষণ মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থেকে, লাইট জ্বালানোর সাথে সাথে সে এক অদ্ভুত শূন্যতা অনুভব করলো। আর সেটা হল অধরার শূন্যতা। আগে কোন দিন নিজেকে এতটা অসহায় মনে হয় নি তার। বুকের ভেতরে কষ্টের ঝড় বয়ে যেতে থাকে। খুব ইচ্ছে করছিল চিৎকার করে কাঁদতে। কিন্তু কাঁদতেও পারছিল না। বুকের ভেতর কষ্ট গুলো জমা হয়ে পাথরের মতো ভারী হয়ে ওঠে। নিঃশ্বাসও নিতে কষ্ট হয় তার। বারবার অধরার সাথে কন্টাক্ট করার চেষ্টা করেও সে ব্যর্থ হয়।
তাই আজকে আর অফিসে যাওয়ার ইচ্ছা হয়নি নিশাদের। প্রায় অর্ধ বেলা পর্যন্ত বিছানায় শুয়ে ছিল। ইতিমধ্যে অধরার মা-বাবার সাথে কথা হলেও কথা হয়নি অধরার সাথে। সে নাকি নিশাদের মতো নোংরা লোকের সাথে কথা বলতে চায় না। বিছানা থেকে উঠে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আনমনে কি যেন স্মৃতিচারণ করছে সে। হয়তো অধরার কথাই ভাবছে। তার তো বৃষ্টি খুবই পছন্দ ছিল। বৃষ্টি হলে ব্যালকনিতে এসে গ্রিলের ফাঁক দিয়ে দুই হাত বাহিরে বের করে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি উপভোগ করত। জ্বর-ঠান্ডা থেকে সতর্ক করার জন্য নিশাদ বারবার নিষেধ করলেও অধরা শুনতে চাইতো না। সে বলতো, ‘চাইলেই আকাশ থেকে বৃষ্টি ঝরানো যায় না। বৃষ্টি অমূল্য, তাই বৃষ্টি হলেই ছুঁয়ে দেখতে হয় নিশাদ।’ আজও কি সে এমনটাই করছে নাকি নিশাদের মত তার মনের আকাশেও অঝোর ধারায় বৃষ্টি নামছে।
নিশাদের স্মৃতিচারণে ব্যাঘাত ঘটলো কারো ফোন কলে। রুমে গিয়ে ফোনের স্কিনের দিকে তাকিয়ে দেখে, অধরার বাবার ফোন কল। নিশাদ ফোনটা রিসিভ করে একটু কাশি দিয়ে গলা ঝেড়ে খুব স্বাভাবিক ভাবে বলল_ হ্যালো বাবা! বলেন? মোবাইলের ওপর প্রান্ত থেকে অধরার বাবা বলল_ বাবা! তুমি কি অফিসে? ফ্রি আছো?
_ না বাবা আমি আজকে অফিসে যাইনি। বাসায় আছি। অধরা কোথায়, কি করে ?
_ অধরা ওর রুমে আছে। শুয়ে রয়েছে। বলছি কি বাবা, আমি জানি না তোমাদের মধ্যে কি হয়েছে। তবে অধরার এভাবে চলে আসাটা একদম উচিত হয়নি। আমি কয়েকবার ওর কাছে জিজ্ঞেস করলাম, আমাকে কিছু বলেনি। তোমার শাশুড়ি আম্মাও বারবার জিজ্ঞেস করছে, তার কাছেও তেমন কিছু বলেনি। তবে সে যে ভেতরে ভেতরে অনেক কষ্ট পাচ্ছে, সেটা আমি বাবা হয়ে খুব ভালোভাবেই টের পাচ্ছি। আমি বলি কি বাবা, আজকে যেহেতু অফিসেও যাওনি, তাই তোমার অফিস থেকে আরও দুই এক দিনের ছুটি নিয়ে তুমি আমাদের এখানে চলে আসো। অধরার সাথে সামনাসামনি কথা বল। ছোটখাটো বিষয় নিয়ে নিজেদের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ করা উচিত না। সমাজের মানুষের এতে মন্দ বলে। তুমি ফ্রেশ-ট্রেস হয়ে এখনই আসার জন্য রওনা দাও বাবা।
_আচ্ছা বাবা আমি ভেবে দেখে আপনাকে জানাচ্ছি।
_আরে ভাবনা-চিন্তার কোন দরকার নাই। তুমি এখনই রওনা দাও তো। আমি বাজারে যাচ্ছি, তোমার জন্য বাজার করতে।
_আচ্ছা ঠিক আছে বাবা! আমি আসতেছি।
স্টেশনে এসে ট্রেনের টিকিট কেটে অপেক্ষায় আছে নিশাদ। নির্দিষ্ট সময়ের কিছুক্ষণ পূর্বে দূর থেকে ভেসে আসতে লাগলো হুইসেলের সুর। টার্মিনাল তিনে ঝকঝক শব্দে দ্রুত ছুটে আসছে অপেক্ষিত ট্রেনটা। এসে থামলো নির্দিষ্ট স্থানে। কিছুক্ষণের মধ্যেই চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে ট্রেনটি ছেড়ে যাবে, এমনই জানান দিলো প্লাটফর্মে কর্মরত এক নারী কণ্ঠস্বর। আন্তঃনগর ‘সূবর্ণ এক্সপ্রেসের ঝ’ নম্বর বগির নির্দিষ্ট আসনে বসে জানালা দিয়ে মানুষের আনাগোনা দেখছে সে। তৎক্ষণাৎ চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেছে ট্রেনটি। তেমন যাত্রী না থাকায়, নিশাদের সামনে এবং পাশের সিট খালিই পড়ে রয়েছে। নিশাদ একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে ট্রেনের জানালার সাথে মাথা রেখে দু’চোখ বুজল। মনের আকাশে ব্যথার কালো মেঘের ঘনঘটা! যে মেঘে হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে নিশাদের।
এমন সময় দশ-বারো বছর বয়সী একটা মেয়ে হাতে কফির ফ্লাক্স নিয়ে এসে নিশাদকে বলল_ ভাইয়া কফি খাবা ?
নিশাদ চোখ খুলে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলল_ না রে বোন, খাবো না!
নিশাদের চোখের কোনে জল দেখে মেয়েটার ভীষণ খারাপ লেগেছে হয়তো! নিশাদের সামনের সিটে বসে মেয়েটি বলল_ ভাইয়া তোমার টাকা দেওন লাগবো না! এক কাপ কফি দেই, খাও তুমি?
নিশাদ শুষ্ক হাসি হেসে বলল_ না লক্ষী বোন আমার, আমি এখন খাবো না!
মেয়েটা মায়াবী একটা হাসি দিয়ে বলল_ ভাইয়া আমি আজ তিন বছর ধইরা কফি বেচি, তয় এখন পর্যন্ত আমারে কেউ কফির জন্য বদনাম করেনি। আমার হাতের কফি নাকি মেলা সুস্বাদু হয়। তুমি একবার খেয়েই দেখো, আমার কফির প্রেমে পড়ে যাইবা! আর তোমার মনডাও ভালো হইয়া যাইবো।
নিশাদ মুচকি হাসি দিয়ে বলল_ তুই তো দেখছি নাছোড়বান্দী! এত মানুষ থাকতে আমাকেই কেন তোর কফি খাওয়াতে হবে?
মেয়েটার মুখ শুকিয়ে গেল, চোখ জলে টলমল করে উঠলো। নিশাদের চোখে চোখ রেখে মেয়েটা বলল_ ভাইয়া, আমারও তোমার মতোই বড়ো একটা ভাই ছিল। আব্বায় আম্মায় মারা যাবার পরে আমার ভাই আমারে আগলাইয়া রাখতো। কত্ত আদর করতো! ভাইয়ের আদরের কারণে আব্বা আম্মার কথা মনেই পড়তো না! কিন্তু আমার ভাইটা মারা যাবার অনেক আগে থেকে তোমার মত এই রকম মন খারাপ করে থাকতো আর গোপনে গোপনে কান্না করতো।
নিশাদ বিস্মিত হয়ে জানতে চাইলো_ কান্না কেন করত সে?
মেয়েটা চোখের পানে মুছতে মুছতে বলল_ তখন তো জানতাম না। তয় ভাই মারা যাবার পরে কাকি কইছিলো, ভাইয়ের নাকি ব্লাড ক্যান্সার হইছিল। আর সেইটা জানার পরে ভাই আমার কথা ভেবে কান্না করতো। ভাই মারা গেলে আমার কি হবে!?
ভাই কমলাপুর স্টেশন একটা চায়ের দোহানে কাজ করতো। যা টাহা পাইতো, সেই টাহা দিয়া দুই ভাই-বোনের সারা মাস যাইতে টেনেটুনে! ভাই মারা যাওনের পর চিন্তা করলাম, কিছু না করলে খামু কি? তাই ভাই যে দোহানে কাজ করতো, ওনার কাছে গিয়ে বললাম আমার একটা কাজ দিতে। পরে উনি কইল, ‘তুই তো মায়া মানুষ, তোরে দেওয়ার মতো তো আমার কাছে কোন কাজ নাই। তুই পোলা মানুষ হইলে, তোর ভাইয়ের জায়গায় তোরে রাইখা দিতাম। তবে তুই যদি চাস, তাহলে তোরে আমি একটা কফির ফ্লাক্স কিনে দিতে পারি। আর সেটা দিয়ে তুই স্টেশনে স্টেশনে কফি বেইচা তোর থাকন খাওনের ব্যবস্থা তুই নিজেই করতে পারবে।’ এরপর থেকে আমি কফি বেচি। তয় ভাইয়ের মত কাউরে কান্না করতে দেখলে আমার খারাপ লাগে!
কষ্টে মেয়েটার কথা আটকে আটকে যাচ্ছে! নিশাদ স্তব্ধ হয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে মেয়েটার মুখের দিকে। অতঃপর মেয়েটিকে ডেকে পাশে বসিয়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল_ একদম কান্না করবি না, এই যে আমি তোর বড় ভাই। আচ্ছা নাম কি তোর ?
_ আমার নাম রুপা।
_ সুন্দর নাম তো তোর। আর নামটাও তোর মত অনেক কিউট। কিউট মানুষের কিউট নাম। তুই লেখাপড়া করিস না ?
_ না ভাইয়া।
_ কেন ?
_ ঠিক মত তিনবেলা ভাত জোটেনা, আবার পড়ালেহা। প্যাটে খিদা থাকলে পড়ালেহা কন আর যাই কন, কোন কিছুই ভাল লাগেনা!
_ আচ্ছা তুই থাকিস কোথায়?
_ আমার কোন ঠিক নেই। এই স্টেশন, হেই স্টেশন। যেহানে রাইত, সেহানে কাইত! তয়, তোমার মন খারাপ কেন আর তুমি যাইতেছ কই ?
_ মনের বারান্দা থেকে প্রিয় মানুষটা রাগ করে পালিয়ে গেছে। তাই তার রাগ ভাঙ্গিয়ে ফিরিয়ে আনতে যাচ্ছি।
গল্পে গল্পে কখন যে পুরোটা সময় চলে গেল টেরই পেল না তারা। ট্রেন সীতাকুণ্ড স্টেশনে থামল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে নিশাদ সন্ধ্যা সাতটা বাজে। এরপর মেয়েটির থেকে বিদায় নিল সে। চারিদিকে বেশ ভালোই অন্ধকার হয়ে গেছে। ঝিরঝির করে বৃষ্টি হচ্ছে, সাথে ঝড়ো বাতাসও বইছে। সব ঝড়-ঝাপটা উপেক্ষা করে নিশাদ অধরাদের বাসায় চলে আসলো। অধরার মা নিশাদের পছন্দের অনেক রকমের খাবার রান্না করেছেন।
পরিবারের সবাই একসাথেই খাওয়া-দাওয়া করতে বসল। অধরা হাসি মুখে সবাইকে টেবিলে খাবার পরিবেশন করে দিচ্ছে। অধরার বাবা-মা মেয়ের মুখে এমন হাসি দেখে অনেকটা নিশ্চিন্ত হলেন। তাই তারা অধরা চলে আসার বিষয়ে আর কথা উঠালেন না। নিশাদও বারবার অধরার দিকে আড়চোখে দেখছিল। মেয়েটা এমন ভাব করছে যেন কিছুই হয়নি। তাহলে কি অধরার রাগ কমেছে? আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছে, নাকি মুখে হাসি ফুটিয়ে কষ্টের বোঝা মনে চেপে সবকিছু স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছে? খাওয়া শেষে, যে যার ঘরে চলে গেলেন।
অধরা বারান্দার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখছিল। নিশাদও অধরার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখতে লাগলো। নিশাদের মনে এক ধরনের প্রশান্তি অনুভব হল। অনেকদিন পর দু’জনে এভাবে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে বৃষ্টি উপভোগ করছে। অনেক কিছু বলতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু কোথা থেকে শুরু করা যায় নিশাদ বুঝতে পারছে না। নিশাদের মনে হচ্ছিলো অধরাও ওকে কিছু বলতে চায়, তবে হয়তো ওর মত অধরাও আন-ইজি ফিল হচ্ছে।
অনেকক্ষণ হচ্ছে দু’জনই চুপচাপ। তাদের নির্বাক্য দেখে রাতের নীরব প্রকৃতিতেও যেন আস্তে আস্তে গারো স্তব্ধতা নেমে আসছে। ঘুমন্ত রাতে চলছে নৈঃশব্দ্যের রাজত্ব। এভাবে অনেক সময় একে অন্যের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সত্বেও যখন দু’জনেই নিরব, নির্বাক্য। নিশাদ তখন অধরার হাতের কনিষ্ঠ আঙ্গুল নিজের কনিষ্ঠ আঙ্গুল দ্বারা আঁকড়ে ধরে অধরার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। ভাবলো অধরা হয়তো এখন নীরবতা ভাঙবে। কিন্তু অধরা আগের মতই নীরব দাঁড়িয়ে আছে। নিশাদ অধরার আরেকটু কাছে গিয়ে অধরাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। খোলা চুল গুলো ঘাড় থেকে সরিয়ে একটা চুমু দিল। তবুও অধরার কোন রেসপন্স না পেয়ে নিশাদ অধরাকে ছেড়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। কিছুক্ষন এভাবে দাঁড়িয়ে থেকে মনে মনে ভাবলো___ অধরা রেসপন্স করছে না ঠিক, তবে বাধাও তো দিচ্ছে না। ওর মনে হয়তো অনেক অভিমান জমেছে। আর স্বামী হিসেবে অভিমান ভাঙ্গানোর দায়িত্ব তো আমার’ই।
নিশাদ এবার অধরাকে বারান্দা থেকে কোলে তুলে, ঘরে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে এলোমেলো চুল গুলো মুখের উপর থেকে সরিয়ে কপালে একটা চুমু দিয়ে বলল_ অধরা আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি।
অধরা এবার নীরবতা ভেঙে প্রশ্ন করলো_ সত্যিই ভালোবাসো?
– হুম, অনেক ভালোবাসি।
– এতই যখন ভালোবাসো, তাহলে সেদিন আমার গায়ে বারবার কেন হাত তুললে? ডিভোর্স লেটারের কথা কেন বললে?
– অধরা এসব কথা থাক না, যা হবার হয়ে গেছে। চলো না, আমরা এসব ভুলে সবকিছু নতুন করে শুরু করি।
– নতুন করে শুরু করতে চাইলেই কি করা যায়?
– একে অপরের প্রতি বিশ্বাস আর ভালোবাসা থাকলে, সব-ই সম্ভব।
– ভালোবাসা? ভালোবাসার মানে তুমি বুঝ? তোমার কাছে ভালোবাসা মানে তো স্ত্রীর সাথে এক বিছানায় রাত কাটানো, তাই না?
– অধরা আমি জানি, তুমি আমার উপর রেগে আছো! ভীষণভাবে রেগে আছো। তাই বলে এভাবে কথা বলতে পারো না।
– তোমার মত নোংরা মানুষের সাথে তো কথা বলতেই ইচ্ছে করছে না। তবুও নিজেকে সংযত রেখে কথা বলছি, এটাই অনেক।
– তোমার কি মনে হচ্ছে না, তুমি একটু বেশিই সাহস দেখাচ্ছো?
– সাহস দেখালে কি করবে, আবার মারবে? তার থেকে ভালো একেবারে মেরেই ফেল।
– অধরা চুপ করো। আমি ধৈর্য হারা হয়ে পড়ছি। তোমাকে ভালোবাসি বলেই চুপ করে আছি। তোমার বলা প্রতিটা কথা নিরবে সয়ে যাচ্ছি। এর বেশি কিছু বললে আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাবে।
– আমাকে ভালোবাসো? হাহাহা, হাসালে। তুমি আমাকে ভাল’ইবাসো না। আমাকে ভালবাসলে আমার গায়ে কোন দিনও হাত তুলতে পারতে না। আমার সাথে অন্যায় করবে আর দিন শেষে ভালোবাসি বলে সবকিছু মিটিয়ে নেবে, বাহ্ কি দারুন প্ল্যান তোমার!
– কোন প্ল্যান নয় অধরা, আমি তোমাকে সত্যিই ভালোবাসি।
– ভালোবাসার নামে আর মিথ্যা বলিও না প্লিজ! আমার আর মিথ্যা শোনার কোন ইচ্ছে নেই। দয়া করে তোমার এই মিথ্যা সম্পর্ক থেকে আমাকে মুক্তি দাও।
– মুক্তি? তুমি কি যা-তা উল্টাপাল্টা বলছো, বুঝতে পারছো ?
– খুব ভালো করেই বুঝতে পারছি। কি ভেবেছো? যা খুশি করবে, গায়ে হাত তুলবে, আর ভালবাসি বলে জড়িয়ে ধরবে। তাহলেই সব ভুলে যাবো? আসলে কি জানো, তুমি আমাকে কখনোই ভালবাসনি। নিজের শারীরিক চাহিদা মেটানোর জন্য এসব বলো। তোমার কাছে ভালোবাসা মানে এক বিছানায় রাত কাটানো। আসলে তোমার আমাকে নয়, একটা নারীর দরকার। নিজের চাহিদা মেটানোর জন্য একটা শরীর দরকার, আর কিছু না।
– অধরা তুমি কিন্তু মাত্রাধিক বাড়াবাড়ি করছো।
– কেন, সত্যি কথা শুনতেই গায়ে ফোস্কা পড়ছে? আসলে আমি যতটুকু বলছি, তুমি এর চাইতেও বেশি খারাপ। তা না হলে সেদিন রাতে দু’টা পর্যন্ত তুমি কোথায় ছিলে? অফিসের সুন্দরী বসের সাথে ছুটির দিনেও রোমান্টিক ভাবে কথা বলতে পারো, আর আমার কথা তোমার কাছে বিরক্তিকর লাগে?
– আমি মেনে নিচ্ছি সব দোষ আমার, কিন্তু তুমি কি নিষ্পাপ? তোমার কোন দোষ নেই? ধরে নিলাম আমি সেদিন তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছি, তোমার উপর হাত তুলেছি, তোমার অভিমান ভাঙ্গাই নাই, রাগ করে বাসায় আসতে দেরি করেছি, কিন্তু স্ত্রী হিসেবে তোমার কি কোন দায়-দায়িত্ব ছিল না? স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কি ঝগড়া বিবাদ হয় না? মনোমালিন্য হয় না? এ ছোট্ট কিছু বিষয়কে তুমি পুঁজি করে, আমাকে না বলে, অনুমতি না নিয়ে এখানে চলে আসলে। চাইলে আমিও তোমাকে সমানভাবে দোষী করতে পারি। আর তুমি বললে না, ‘তোমার মত নোংরা মানুষের সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।’ তাহলে আমি বলবো কি, তুমি আমার থেকেও বেশি নোংরা মনের। নিজের স্বামীকে যে এতটা নিচে নামাতে পারে, তার সম্পর্কে যে এতটা নোংরা অপবাদ দিতে পারে, স্বামী-স্ত্রীর পবিত্র ভালোবাসাকে যে এভাবে খারাপ তকমা দেয়, সে আর যেমনই হোক, ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য নয়। তুমি মুক্তি চাইছো না আমার কাছে? অকে, সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে। _এই বলে নিশাদ ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে লাগলো। অধরা পেছন থেকে বলল_ কোথায় যাচ্ছো?
– কোথায় আর যাবো! আমার তো একজন নারীর দরকার, নিজের চাহিদা মেটানোর জন্য। একটা শরীর দরকার, তার খোঁজেই যাচ্ছি!
– বাহিরের অবস্থা তো ভালো না! অনেক ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছে।
– আমার মনের ভেতরে চলা ঝড়ের তুলনায়, এটা কিছুই না।
এতো রাতে মেইন গেট খোলার আওয়াজ শুনে অধরার মা-বাবা নিজেদের রুম থেকে উঠে এলেন। মেইন গেট খোলা দেখে অধরার মা আরেকটু কাছে এসে দেখলেন নিশাদ এই গভীর রাতে ভরা বৃষ্টির মধ্যে চলে যাচ্ছে। অধরার মা রাগে আধরার রুমে গিয়ে কর্কশ ভাষায় বললেন_ এই ছিল তোর মনে? কি এমন বলেছিস যে, এমন ভরা বৃষ্টি মাথায় নিয়ে তার যেতে হল?
– আমি এই সম্পর্কটা থেকে মুক্তি চেয়েছি!
মেয়ের মুখে এমন কথা শুনে চমকে যায় অধরার বাবা-মা দু’জনেই। তারা বুঝতে পারল, এখন বকাবকি করলে কাজ হবে না, মেয়েকে বুঝতে হবে।
অধরার বাবা অধরার পাশে গিয়ে বসলেন। মাথায় হাত রেখে বললেন, ‘মা রে জীবনে চলতে গেলে ক্ষমা করা শিখতে হবে। কারণ ক্ষমাই তোকে একমাত্র মানসিক শান্তি দিতে পারে। অতীত কি কেউ বদলাতে পারে? পারে না। আমি জানি না তোদের মধ্যে কি হয়েছে। কারণ তুই পরিষ্কারভাবে এখনো আমাদের কিছুই বলিস নি। কিন্তু যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। এসব নিয়ে যত চিন্তা ভাবনা করবি, কষ্ট বাড়বে বৈ কি কমবে না। তোর এই রাগ, অভিমান নিশাদের থেকে তোকে অনেক দূরে নিয়ে যাবে। আর এই দূরত্ব তোর মানসিক কষ্ট আরো বাড়িয়ে দিবে। তোর মায়ের সাথে কি আমার ঝগড়া হয় না? রাগের মাথায় ঝগড়া করলেও যখন রাগ শেষ হয়ে যায়, তখন সব ভুলে যাই। আরে পৃথিবীটাই তো এমন। সংসারে ঝগড়া থাকবে, ভালোবাসা থাকবে, এমনই তো হয় সংসার।’
– কিন্তু বাবা, নিশাদ তো আমার কাছে ক্ষমা চাইতে পারতো। তবে চাইল না কেন?
– সেটা আমি জানিনা। তবে একটা কথা মনে রাখবি_ ছেলেরা মনে মনে যা চায়, সব সময় সেটা মুখে বলতে পারে না। তোকে আমি কথাটা বাবা নয়, একজন পুরুষ হিসেবে বললাম। তাকে বোঝার চেষ্টা কর, তাহলে দেখবি সে তোকেও বুঝতে পারবে। একটা সম্পর্ক শেষ করে দিলেই কি সবকিছু শেষ হয়ে যায়? ধরলাম তুই নিশাদের সাথে সম্পর্ক শেষ করে দিতে চাইলি, নিশাদ তোকে ডিভোর্স দিয়ে দিল। এরপর তুই কি করবি? সন্তান কখনো মা-বাবার কাছে বোঝা হয় না। তাই আমরা না হয় বিষয়টা মেনে নিয়ে তোকে ঘরে রাখলাম, কিন্তু এই সমাজ? সমাজের মানুষ, তারা কি মেনে নিবে? কখনোই না! দু’দিন আগে হোক পরে হোক তোকে আবার অন্য কারোর সাথে সংসার করার জন্য যাওয়া লাগবে। সে যদি নিশাদের থেকেও বেশি খারাপ হয়, তখন কি করবি ? সে সম্পর্ক থেকে আবার মুক্তি চাইবি?
মা রে, জীবনে না চাইতেও অনেক কিছু করতে হয়, বাধ্য হয়েই করতে হয়। মেয়েরা চাইলে নিজের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিতে পারে না। অনেক বাধ্যবাধকতা থাকে। মেয়েদেরকে অনেক সময় অন্যায়, অবিচার হজম করেই চুপ করে সংসার করে যেতে হয়। আমাদের সমাজ ব্যাবস্থাটাই এমন, আমরা এর বাইরে নই। বাইরে থেকে অনেকেই তোকে বলবে, ‘এমন অন্যায় মেনে নেওয়া যায় না, এমন খারাপ লোকের সাথে সংসার করা যায় না, সব ছেড়ে নিজের মতো বাঁচতে শেখো।’ কিন্তু তুই ওদের কথা শুনে একা থাকার সিদ্ধান্ত নিলেও, একাকীত্বের সময় তুই তাদের কাউকে পাশে পাবি না। তারাই একসময় তোর দিকে আঙুল তুলে বলবে, ‘স্বামীর ঘর করতে পারেনি, ডিভোর্সি।’ যা হয়েছে ভুলে যা। সব ভুলে গিয়ে জীবনটা নতুন করে শুরু কর বলে অধরার বাবা নিজের ঘরে চলে গেলেন।
অধরার বাবা চলে যাওয়ার পর, অধরা চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো। কেন জানি অপরাধ বোধ হচ্ছে ওর। নিশাদের জন্যও চিন্তা হচ্ছে এখন। তখন রাগের মাথায় কত কিছু বলেছে। মনের যত জমানো রাগ ছিল, সব ওর উপরে ঝেরেছে। অনেক দিনের জমানো রাগ ঝেড়ে হালকা হলেও, স্বস্তি মিলছে না কোথাও।
বৃষ্টি পড়ছে অবিরাম, থামার কোনো লক্ষণ নেই। সাথে চলছে বজ্রপাতের আওয়াজ, যেন বৃষ্টি আর বাজ একসাথে সুর বেঁধেছে। কিন্তু নিশাদের তাতে কোনো মনোযোগ নেই। গভীর রাতের নিস্তব্ধতা বৃষ্টির শব্দে আরও গভীর হয়েছে। শহরের ফাঁকা রাস্তায় কোনো গাড়ি নেই, জনমানবশূন্য সেই রাস্তায় একা ভিজতে ভিজতে হাঁটছে নিশাদ। শরীরে ঝরছে বৃষ্টি, মাথার ওপর থেকে পায়ের তলা পর্যন্ত ভিজে একাকার। কিন্তু ভেতরের যে আগুনটা জ্বলছে, সেটা নিভছে না। মনের গভীরে একটা অসহায়ত্ব, একটা অস্থিরতা তাকে ছুটিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
হাঁটতে হাঁটতে নিশাদ স্টেশনে পৌঁছল। স্টেশনের চারপাশটাও যেন বৃষ্টিতে ঢেকে গেছে, প্ল্যাটফর্মের এক কোণে কয়েকজন লোক নিজেদেরকে একটা বস্তায় জড়িয়ে শুয়ে আছে, যেন এই বস্তাটাই তাদের সম্বল। তাদের ঠিক পাশে ষাটের উপর বয়সী একজন বৃদ্ধ বসে আপন মনে বিড়ি টানছেন। যেন এই মুহূর্তটা তার কাছে পৃথিবীর সব সুখের চেয়েও বেশি কিছু। একে একে বিড়ির ধোঁয়া মেঘের মতো মিলিয়ে যাচ্ছে।
স্টেশন মাস্টারের ঘরও বন্ধ। দরজা লাগিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়েছে সে। নিশাদ আশেপাশে তাকিয়ে দেখল, স্টেশনের শেষ প্রান্তে কেউ একজন জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। দূর থেকে ঠিকমতো দেখা যাচ্ছে না, শুধু ঝাপসা আলোয় একটা অস্পষ্ট অবয়ব। কৌতূহলবশত নিশাদ ধীরে ধীরে পা টিপে সেই দিকে এগিয়ে গেল।
_ রুপা তুই? এখানে কি করছিস?
রুপা একটু হতচকিত হয়ে কাঁচুমাচু গলায় বলল_ হ ভাইয়া আমি। বইসা আছি। কফি বেইচা সব শেষ করার পরে কমলাপুরে ফিরে যাইতে ছিলাম। তয় মেলা খিদা লাইগা গেল। এহানে নামলাম রুটি কেনার জন্য। পরে রুটি কিনতে গিয়া দেরি হয়ে গেল। ট্রেন ছাইড়া দিছিলো আমি আর উঠতে পারি নাই। এহন আজকে আর ঢাকার কোন ট্রেন নাই। ওটাই আজকের সর্বশেষ ট্রেন আছিল। এখন কালকে ছাড়া আর যাওন যাইবো না। এজন্য বইসা আছি। তয় তোমার মনের মানুষ কই? তারে লগে কইরা ফিরাইয়া আনো নাই? নাকি তার রাগ কমে নাই?
_ না রে বোন আমার। সে এখন আমার কাছে মুক্তি চায়। তাই তাকে মুক্তি দিয়ে চলে আসলাম।
_ তয় এই বৃষ্টির ভেতর কাক ভেজা না হইয়া, এহন না আইলেও তো পারতা। সকালে আইতা।
_ চাইলেই তো আমরা বৃষ্টিকে ডেকে আনতে পারি না, সে তো ভালোবাসার মুগ্ধতায় নিজেই এসে ধরা দেয়। তার স্নিগ্ধ স্পর্শ যদি না অনুভব করি, তবে সেই মুহূর্তের অর্থই যেন হারিয়ে যায়! তবে মুহূর্তটা স্বাদহীনরে রুপা।
এরপর নিশাদ পকেট থেকে কয়েকটি নীল চুড়ি বের করে রুপার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল_ তোর হাতে এই নীল চুড়িগুলো ভীষণ মানাবে। এটা আমার তরফ থেকে তোকে দিলাম। স্মৃতি হিসেবে সযত্নে হাতে রেখে দে। বিষাদময় এই মুহূর্তটা মনে পড়বে কোন বৃষ্টি ভেজা রাতে, অথবা কোন ট্রেন স্টেশন দেখলেই। সাথে বিষাদময় কিছু স্মৃতি ভেসে উঠবে লিপিবদ্ধ করা জীবনের ডায়েরি থেকে।
রুপা একটু অবাক হয়ে চুড়িগুলো হাতে নিয়ে বলল_ কিন্তু তুমি এই রাইতে চুড়ি কই পাইলা!?
নিশাদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল_ ভালোবাসার মানুষটার নীল চুড়ি ভীষণ পছন্দ ছিল। তার জন্য কিনে এনেছিলাম। তাকে তো আর দেয়া হয়নি। সময়ের সাথে চুক্তি করে সে হারিয়ে গেল। তাই ভাবলাম_ আর পকেটে নয়, চুড়িগুলো অন্তত কারো হাতে শোভা পাক!
রুপা ভীষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে নিশাদের দিকে। আর মনে মনে ভাবছে, ‘সত্যিকারের ভালোবাসা গুলো বুঝি এভাবেই হারিয়ে যায়।’
নিশাদ রুপার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল_ তুই থাক, আমি যাই। আর আগামীকাল সন্ধ্যার সময় তুই কমলাপুর স্টেশনে থাকবি। তোকে আর কফি বিক্রি করতে হবে না। আপাতত লেখাপড়া করবি। আজ থেকে তুই আমার বোন। এই বৃষ্টি মাখা রাত না হলে, এখনই তোকে আমি সাথে করে নিয়ে যেতাম।
_ কিন্তু ভাইয়া তুমি এহন যাইবা কিভাবে ? কোন গাড়ি তো পাইবা না এহন। আর ট্রেনও তো নাই।
_ বাস স্ট্যান্ডে গিয়ে দেখি কোন গাড়ি পাই কিনা! হয়তো পাওয়া যাবে।
_ তয় তুমি বৃষ্টির মধ্যে আবার ভিজবা। তোমার তো শরীর খারাপ হইবো, জ্বর আইবো।
নিশাদ এক গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে গভীর কণ্ঠে বলল__ জীবনের পাল্লায় যখন সুখের চেয়ে দুঃখের মুহূর্তগুলো বেশি ভারী হয়ে ওঠে, তখন জীবনটা আর আগের মতো জীবন থাকে না, রে রুপা। জীবন তো আর কোনো রূপকথার গল্প নয়। এখানে আমাদের ইচ্ছেমতো কিছুই হয় না। কিন্তু একটা কথা জানিস? যদি আপন মানুষগুলো সব রাগ, মান-অভিমান, কষ্ট ভুলে গিয়ে পাশে দাঁড়ায়, ক্ষমা করে দেয়—তাহলে জীবনটা রূপকথার মতোই হয়ে ওঠে, এমনকি তার থেকেও সুন্দর।
রুপা নীরবে শুনছিল, নিশাদের প্রতিটি শব্দ যেন তার মনের গহীনে গিয়ে আঘাত করছে। তার চোখে একটা অদ্ভুত ভাব ফুটে উঠল, যেন সে অনেক কিছু ভাবছে কিন্তু মুখে কিছুই বলতে পারছে না। তার মনোকষ্ট চুপচাপ ফুটে উঠছে সেই নীরবতার মধ্যে। নিশাদ একটু থেমে, একটা মৃদু হাসি দিয়ে বলল___ আচ্ছা, তুই থাক। কাল সকালেই ট্রেন ধরে ঢাকায় চলে যাস। আর শোন, কাল সন্ধ্যায় কমলাপুর স্টেশনে থাকিস। তোর আর এই কফি বিক্রি করা লাগবে না। আপাততঃ পড়াশোনা করবি। তবে তোকে এখনি সাথে করে নিয়ে যেতাম, তবে ভারী বৃষ্টির কারণে আর নিলাম না। _এই বলে নিশাদ বিদায়ের ইঙ্গিত দিয়ে, আস্তে আস্তে পেছন ফিরে হাঁটা শুরু করল। রুপা তার পথের দিকে তাকিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল, যেন কিছু বলতে চায় সে, কিন্তু বলার কোনো ভাষা পাচ্ছে না। নিশাদ ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে গেল বৃষ্টির ধোঁয়াটে আচ্ছাদনে।
চারিদিকে ঘন অন্ধকার। আকাশ যেন বেদনায় মগ্ন, তার বুক ফেটে ঝরছে একটানা মুষলধারে বৃষ্টি। বৃষ্টির সেই ভারে পৃথিবী ঢেকে গেছে এক বিষণ্ন পর্দায়, চারপাশে নেমে এসেছে একরাশ নির্জনতা। রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা ল্যাম্পপোস্টের ক্ষীণ আলোও সেই অন্ধকারে মিশে গেছে, তাতে আর সামান্য আলোও ছড়াতে পারছে না দূর পর্যন্ত। নিশাদ ধীরে ধীরে হাঁটছে, বৃষ্টির শব্দ ছাড়া চারপাশে একদম নিস্তব্ধ। তার মন এলোমেলো, হাজারো চিন্তা মাথার ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে। একের পর এক প্রশ্ন ভেসে আসছে তার মনে, কিন্তু কোনো প্রশ্নেরই উত্তর খুঁজে পাচ্ছে না। প্রতিটি পা যেন ভারী হয়ে উঠছে, প্রতিটি চিন্তা তাকে আরও বেশি অস্থির করে তুলছে। নিঃশব্দে সে এগিয়ে চলছে, কিন্তু মনের অশান্তি তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে, সে নিজেও জানে না।
ঠিক তখনই, আচমকা পেছন থেকে কেউ একজন নিশাদের মাথায় কোনো ভারী বস্তু দিয়ে জোরে আঘাত করল। আঘাতটা এতটাই তীব্র ছিল যে, নিশাদ কোনো রকমে সামলানোর চেষ্টা করেও নিজেকে ধরে রাখতে পারল না—সরাসরি রাস্তার পাশে উপুড় হয়ে পড়ে গেল। মাথাটা ঘুরছে, দৃষ্টিটা ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। নিশাদ মাটি থেকে উঠে বসতে চেষ্টা করল, কিন্তু তখনই তার বুকের ওপর কে যেন হঠাৎ লাফিয়ে চড়ে বসল। নিশাদ ভয় আর কষ্টের মাঝে ক্ষীণ কণ্ঠে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল___ কে আপনি? কি চান?
কিন্তু তার প্রশ্নের কোনো উত্তর এল না। লোকটা কোনো কথা না বলে উন্মাদের মতো নিশাদের বুকে বারবার ছুরি চালাতে থাকলো। প্রতিটি আঘাত যেন আরও গভীর, আরও তীব্র হয়ে উঠছে। নিশাদের শরীর ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে, কণ্ঠ থেকে আর কোনো শব্দ বের হচ্ছে না। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে, চারপাশের বৃষ্টির শব্দও যেন মিলিয়ে গেছে কোথাও।
দূর থেকে হঠাৎ করে একটা গাড়ির শব্দ ভেসে এলো। গাড়ির হেডলাইটের আলো সামনে এসে রাস্তার অন্ধকার ভেদ করে চারপাশকে আলোকিত করে তুলল। সেই আলো দেখেই নিশাদের মনে এক মুহূর্তের জন্য আশার একটা কিরণ জ্বলে উঠল, যেন বেঁচে থাকার একটা শেষ সুযোগ তার সামনে হাজির হচ্ছে। কিন্তু তার শরীর এতটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে যে, কোনো শব্দ করতেও পারছে না—শুধু নিস্তব্ধভাবে তাকিয়ে রইল, নির্লিপ্তভাবে অপেক্ষা করতে লাগল তার ভাগ্য নির্ধারণের জন্য।
ভোর সকালে ঘুমিয়ে থাকা অবস্থায় অধরার বাবার নাম্বারে একটা ফোন এলো। অধরার বাবা ফোনটা রিসিভ করতেই মোবাইলের ওপর প্রান্ত থেকে ভেসে আসলো_ আমি সীতাকুণ্ড থানার এস আই রফিকুল ইসলাম বলছি। থানার কথা শুনতেই অধরার বাবা বিছানা থেকে উঠে বসে পড়ে।
_ জি স্যার, জি স্যার বলুন, কি হয়েছে?
_ গতকাল দুপুর ১২টার দিকে ০১৩৬৫৪……… নাম্বার থেকে সর্বশেষ আপনার সাথে ৪ মিনিট ৪৭ সেকেন্ড কথা বলা হয়েছে। এছাড়াও এই একই নাম্বার থেকে গতকাল আপনার সাথে আরো কয়েকবার কথা হয়েছে। এই নাম্বারটা কার? তার সাথে আপনার সম্পর্ক কি?
_ এই নাম্বারটা আমার মেয়ে জামাইয়ের নাম্বার। কেন স্যার কি হয়েছে?
_ সীতাকুণ্ড রেলস্টেশন থেকে কিছুটা দূরে একটা লাশ পাওয়া গেছে। আর লাশের পাশেই এই সিমটা পাওয়া গেছে। আপনাকে এখনই সীতাকুণ্ড সরকারি হাসপাতালে আসতে হবে।
_ আচ্ছা স্যার, আমি এখনই আসতেছি!
_ জ্বী, দ্রুত আসেন—বলে ফোন কেটে দিল।
লাশের কথা শুনেই সবার মনে ভয় আর বিষণ্নতা ঘিরে ধরল। “নিশাদের কিছু হলো না তো?”—এই চিন্তাই অধরার বুকটাকে ধক করে কাঁপিয়ে তুলল। সারা শরীরে যেন হিমশীতল শীতলতা ভর করল, চোখ-মুখ ধীরে ধীরে ঝাপসা হয়ে এলো। গলা শুকিয়ে কাঠ, বারবার ঢোঁক গিলছে, কিন্তু কিছুতেই স্বস্তি মিলছে না। মনের অস্থিরতা ক্রমশ বেড়ে চলল। এক মুহূর্তও দেরি না করে দ্রুত একটি সিএনজি ডাকা হলো। অধরা, তার বাবা-মা সবাই তাড়াহুড়ো করে রওনা দিলেন, মনে গভীর এক অজানা আশঙ্কা নিয়ে।
সিএনজি এসে হাসপাতালের সামনে থামলে, অধরার বাবা চুপচাপ ভাড়া মিটিয়ে দ্রুত ভেতরে ঢুকে গেলেন। অধরা আর তার মা নিঃশব্দে বাবার পিছু নিল। তারা একটি নির্দিষ্ট রুমের সামনে এসে থামল, যেখানে কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা দাঁড়িয়ে আছেন। অধরার বাবা ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে গিয়ে শান্ত কণ্ঠে বললেন_ আমি জাহিদ মিয়া। ভোরবেলা আমাকে ফোন করে একটা লাশের ব্যাপারে জানানো হয়েছে এবং এখানে আসতে বলা হয়েছে।
অধরার বাবার কথা শুনে এস আই রফিকুল ইসলাম একটা ছবি দেখালেন। অধরার বাবা ছবিটি দেখে লাশ শনাক্ত করলেন। অতঃপর এস আই রফিকুল ইসলাম হাতের ইশারায় একটা রুম দেখিয়ে ৭২১ নাম্বার ড্রয়ারের কথা বললেন।
অধরা তড়িঘড়ি করে দৌড়ে গিয়ে ৭২১ নাম্বার ড্রয়ার খুঁজতে লাগল। হ্যাঁ, এই তো ৭২১। কিন্তু ড্রয়ারটি খুলতে গিয়ে তার হাত-পা কাঁপতে লাগল, যেন শরীর অবশ হয়ে আসছে। মাথা কাজ করছে না, সবকিছু যেন ঝাপসা লাগছে। মনে হচ্ছিল, সে পাগলের মতো আচরণ করছে। ঠিক তখনই একজন নার্স রুমে ঢুকে তাদের দেখে বললেন___ এখানে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা যাবে না। যদি লাশ দেখতে চান, তাহলে তাড়াতাড়ি দেখে বের হয়ে যান।
অধরার বাবা ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে ড্রয়ারটা খুললেন। ড্রয়ারের ভেতর নিশাদের নিথর দেহটা দেখে অধরার বুকটা হাহাকার করে উঠল। তার মুখটা ফ্যাকাশে, প্রাণহীন। সেই দৃশ্য সহ্য করতে না পেরে অধরা সঙ্গে সঙ্গেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলল। জ্ঞান ফেরার পর অধরা ছুটে আবার মর্গের রুমে যেতে চাইলে, তার মা জড়িয়ে ধরে আটকে রাখলেন। তাকে কিছুতেই যেতে দিলেন না। অধরা কান্নায় ভেঙে পড়ে মাকে জিজ্ঞেস করল_ কেন মা? কেন এমন হলো? আমি তো এমন কিছু চাইনি। সত্যি বলছি মা, আজ নিশাদের সঙ্গে সব ভুল বোঝাবুঝি মিটিয়ে তোমাদের চমকে দেওয়ার কথা ভেবেছিলাম। কিন্তু কে জানত, নিশাদই আমাকে এমনভাবে চমকে দেবে! মা, আমি তো এমন মুক্তি চাইনি। কেন এমন হলো মা, কেন?
অধরার বাবা এসআই রফিকুল ইসলামের কাছে জানতে চাইলেন_ মৃত্যুর কারণ কী?
এস আই রফিকুল ইসলাম বললেন_ ভিকটিমের মাথার পেছনে একটি বড় আঘাত রয়েছে। সম্ভবত অপরাধী তাকে পিছন থেকে আঘাত করেছে, যাতে সে অচেতন হয়ে পড়ে। পায়ে সামান্য আঘাতের চিহ্নও পাওয়া গেছে এবং ডান হাতের রগ কাটা। ধারণা করা হচ্ছে, ভিকটিম হাত দিয়ে অপরাধীর আঘাত প্রতিরোধ করতে গিয়ে হয়তো রগ কেটে গেছে। এছাড়া, বুকের উপর ধারালো অস্ত্র দিয়ে ১১টি আঘাত করা হয়েছে। তবে এটি এখনও নিশ্চিত করা যায়নি যে, এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড নাকি ছিনতাইয়ের উদ্দেশ্যে হত্যা করা হয়েছে। কারণ, লাশের কাছাকাছি বা আশেপাশে আমরা একটি সিম ছাড়া আর কিছুই পাইনি। সম্ভবত ভিকটিম ইচ্ছাকৃতভাবে মোবাইল থেকে সিমটি খুলে ফেলেছে, কারণ সে জানতো সিম থাকলে বিপদে পড়তে হতে পারে। এমনকি লাশের হাতের আঙ্গুলের আংটিও খুলে নেওয়া হয়েছে, আঙ্গুলের ওপর স্পষ্ট ছাপ রয়ে গেছে। এ থেকেই ধারণা করা হচ্ছে, এটি একটি ছিনতাইয়ের উদ্দেশ্যে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু বুকের ওপর ১১টি আঘাত স্পষ্টভাবে বোঝাচ্ছে যে, এটি একটি পরিকল্পিত খুন। মনে হচ্ছে, ভিকটিম প্রতিশোধের নেশায় উন্মাদ হয়ে তাকে হত্যা করেছে।
রাত তিনটার দিকে এক ট্রাক ড্রাইভার রাস্তার পাশে ভিকটিমকে পড়ে থাকতে দেখে ৯৯৯ নম্বরে ফোন করে সংবাদ দেন। তৎক্ষণাৎ আমরা ঘটনাস্থলে একটি টিম পাঠাই, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, টিম পৌঁছানোর আগেই তার মৃত্যু ঘটে। তবে, ইতিমধ্যে আমাদের তদন্ত টিম গঠন করা হয়েছে। আমরা দ্রুত অপরাধীর সন্ধানে পৌঁছে যাব এবং অপরাধী যেই হোক না কেন, তার জন্য সর্বোচ্চ শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে।
পুলিশ কর্মকর্তার মুখ থেকে মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে শুনে অধরা হতভম্ব হয়ে তার বাবার দিকে তাকিয়ে বলল_ বাবা, আমি নিশাদকে মেরে ফেলেছি। আজ তার মৃত্যু আমার কারণেই হয়েছে। কেন আমি গতকাল তাকে থামালাম না? যদি থামাতাম, হয়তো আজ সে পৃথিবীতে বেঁচে থাকতো, আমাদের সাথে থাকতে পারতো।—কথাগুলো বলতে বলতে সে মাটিতে হেলে পড়ে চিৎকার করে কাঁদতে লাগল। অধরার মা তার পাশে দাঁড়িয়ে, চোখের জল মুছতে মুছতে কাঁদছিলেন। অধরার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল, এবং তার মস্তিষ্কের নার্ভগুলো অচল হয়ে আসতে লাগলো। সহ্যসাধ্য না হওয়া এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তির জন্য সে হাসপাতাল থেকে বের হয়ে খোলা আকাশের নিচে চলে গেল। সেখানে গিয়ে সে অব্যাহতভাবে চিৎকার করে কাঁদতে লাগল, যেন সমস্ত পৃথিবী তার যন্ত্রণার প্রতিধ্বনি শোনার জন্য অপেক্ষা করছিল।
খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে অধরা অনুভব করল, যেন আকাশ-বাতাস, গাছপালা, সব কিছুই তাকে বলতে চাচ্ছে_ অধরা, তুমি কেন কাঁদছো? তুমি তো এটাই চেয়েছিলে! আজ থেকে তুমি মুক্ত, তুমি স্বাধীন! আজকের পর থেকে কেউ তোমাকে কষ্ট দিতে পারবে না, আর কেউ তোমার গায়ে হাত তুলবে না। এখন তো তোমার খুশি হওয়া উচিত!
তবে, কাঁদতে কাঁদতে অধরা ভাবতে লাগলো_ জীবন কত অদ্ভুত! আমি যে সামান্য অভিমান নিয়ে মুক্তির জন্য প্রার্থনা করেছিলাম, সেই মুক্তির আসল রূপ নিয়ে আমাকে বড় অভিমান দিয়ে বিদায় জানানো হলো। অথচ মুক্তি পাওয়ার পরও, আমি খুশি হতে পারছি না।
নিশাদের দাফন শেষ হলো। একে একে সবাই চলে যাচ্ছে। সন্ধ্যার আবছা আলো নেমে এসেছে, আর সাথে শুরু হয়েছে মুষলধারে বৃষ্টি। অধরার মা তার হাত ধরে নিয়ে যাচ্ছিলেন, কিন্তু অধরা তার মায়ের হাত ছাড়িয়ে কবরের কাছে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। ভেজা মাটির খুব কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল_ নিশাদ, আমি এই মুক্তি চাইনি! সত্যি চাইনি আমি এই অভিশপ্ত মুক্তি।