আমার নাম নাহিদ। আব্বু-আম্মুর একমাত্র সন্তান। তাঁরা আমাকে খুব আদর করতো। হয়তো আব্বু-আম্মুর একমাত্র সন্তান হওয়ায় আদর, ভালোবাসা, মায়া, মহব্বত আমার প্রতি একটু বেশি ছিল। কিন্তু এই আদর, ভালোবাসা আমার জীবনে বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। আমার বয়স তখন কত হবে? বড়জোর পাঁচের কোঠায়।
বাবা আমাকে খেলার জন্য নানা রকমের খেলনা কিনে দিত। ছোটবেলা থেকে-ই আমি মোটরবাইক খুব পছন্দ করি। সেই সুবাদে বাবা আমাকে কয়েকটা খেলনা বাইক কিনে দিয়েছিলেন।
প্রতিদিনের মত সেদিনও আমি ব্যালকনিতে বাইক নিয়ে খেলা করছিলাম। হঠাৎ আম্মু আমার গালে সাত কেজি ওজনের একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিল। থাপ্পড় খেয়ে আমি ত্রিশ সেকেন্ডের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেলাম । ভয়ে প্যান্টে হিসু করে দিলাম। আম্মু আমাকে কোন দিন একটা ফুলের টোকাও দেয়নি। কিন্তু সেই আম্মু আজ আমাকে এত জোরে থাপ্পড় মারল! কে জানে! মনের অজান্তে হয়তো কোন অপরাধ করেছি ?
বাবা বলল; ‘তুমি ওকে মারলে কেন? ঝগড়া হচ্ছে আমার সাথে, তুমি ওর গায়ে হাত তুললে কেন? এতটুকু ছেলের গায়ে হাত তুলতে কি তোমার একটুও বুক কাঁপল না?’ আম্মু বাসা কাঁপিয়ে চিৎকার করে বলল; ‘না, কাঁপল না। আমি আজ থেকে এমন-ই করব। তোমার ভালো না লাগলে বাসা থেকে বের হয়ে যাও।’ বাবা বললো: ‘আমি বের হয়ে যাবো? অবাক ব্যাপার তো! আমার সংসার ছেড়ে আমি কেন বের হয়ে যাবো ? আম্মু তাচ্ছিল্যের সুরে বলল; ‘হেই, তোমার সংসার! সংসারে তোমার আছেটা কি? সবই তো আমার বাবার দেওয়া যৌতুকের টাকায় কেনা।’ বাবা বলল; ‘মাহমুদা আর একটা কথাও বলবা না। ছেলের সামনে আমি এসব বিষয় নিয়ে কোন কথা বলতে চাই না।’ আম্মু: ‘এখন চাইবে কেন? আমার বাবার কাছ থেকে যৌতুক নেওয়ার সময় মনে ছিল না? এখন লজ্জা লাগছে?’
আমি আম্মুর হাতে থাপ্পড় খেয়ে, ভয়ে ভেজা প্যান্টে দরজার পিছনে গিয়ে লুকিয়ে আছি। বাবা আর আম্মুকে এই প্রথম ঝগড়া করতে দেখছি। বাবা ঝগড়ায় মায়ের সঙ্গে সুবিধা করতে না পেরে চুপ হয়ে গেল। কিন্তু আম্মু চুপ হল না। সে এক তরফা ঝগড়া চালিয়ে-ই যেতে থাকল। এমনকি একপর্যায়ে রান্না ঘরে গিয়ে থালা-বাসন ছোড়া-ছুরি শুরু করে দিল।
_বাবা; ‘ভাঙ্গো, যত ইচ্ছা ভাঙ্গো। ভেঙে সব গুঁড়িয়ে দাও। সবই তো তোমার বাবার যৌতুকের টাকায় কেনা। কিছুই বলবো না আমি।’ এরপর বাবা ক্লান্ত হয়ে খাটের উপর গিয়ে বসে পড়লো। ঝগড়ায় সে মুলতবি ঘোষণা করেছে। আমিও চুপ-চাপ গিয়ে বাবার পাশে বসে পড়লাম। আম্মুর হাতে থাপ্পড় খাওয়ার পর থেকে বাবা’ই যেন আমার একমাত্র আশ্রয়স্থল। আম্মু রান্না ঘর থেকে বের হয়ে আমাকে বলল; ‘বাবার পেটের ভেতরে ঢুকে বসে আছো কেন? নিচে নেমে এসো, আমরা এখনই তোমার নানুর বাসায় চলে যাব।’ আমি শক্ত করে বাবার কোমর জড়িয়ে ধরলাম। তাঁকে ছাড়া এই মুহূর্তে নানুর বাসায় যাওয়ার ইচ্ছে আমার নেই। আম্মু চোখ রাঙিয়ে বলল; ‘এই ছেলে, আসছো না কেন?’ আমি বাবার দিকে তাকিয়ে আছি। তাঁকে ছাড়া যেতে চাইনা। এখন তাঁরই সমর্থনের অপেক্ষায়। বাবা বলল; ‘তুমি যেতে চাইলে যাও। নাহিদ যাবে না।’
_আম্মু; ‘কেন যাবে না? ছেলে তোমার না। ছেলে আমার। আমার কথাই সে শুনবে। এই ছেলে নেমে এসো বলছি।’ আমি আরো শক্ত করে বাবার কোমর জরিয়ে ধরলাম। আম্মুকে এই মুহূর্তে আমার কাছে মনে হচ্ছে একটা রাক্ষসী। আর বাবা হচ্ছে রাজকুমার। সুতরাং রাজকুমারই পারে রাক্ষসীর হাত থেকে এই ছোট নাহিদকে উদ্ধার করতে।
বাবা শেষ পর্যন্ত আমাকে নানুর বাসায় যাওয়া থেকে উদ্ধার করেই ছাড়ল। আর আম্মু নানুর বাসায় একা-একাই চলে গেল। যাওয়ার সময় বাবাকে বলে গেল; ‘এই যে গেলাম, আর আসবো না। তোমার সাথে এই নরকে থাকার মোটেও ইচ্ছে নেই। খবরদার আমাকে একবারও ফোন দেওয়া বা আমার সাথে কোনো ধরনের যোগাযোগ করার চেষ্টা করবে না। তাহলে কিন্তু খারাপ কিছু হয়ে যাবে।’ বাবা চুপ-চাপ জানালা দিয়ে বাহিরের দিকে তাকিয়ে রইল। কিছু বলল না। বাবার অবস্থা সে সময় পৃথিবীর কেউ অনুভব করতে না পারলেও, আমি কিছুটা অনুভব করতে পারছিলাম। আমি দেখছি, তাঁর দুই চোখ থেকে অঝোরধারায় গড়িয়ে পড়ছে অশ্রুধারা। বাবাকে এই প্রথম কাঁদতে দেখলাম। কিন্তু বাবার চোখের পানিতেও আম্মুর মাঝে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখতে পেলাম না।
বাসায় এখন আমি আর বাবা ছাড়া মনে হয় একটা পিপীলিকাও নেই। আব্বু-আম্মুর ঝগড়া দেখে সবাই পালিয়ে গেছে। বাবা আমাকে বলল; ‘কিরে বাবা, তোর আম্মু তো চলে গেল? এখন কি হবে? রান্না কে করবে? আর খাবিই বা কি?’
_আমি মাথা নেড়ে বললাম; ‘কিছুই খাব না বাবা। আমি রাজকুমার আর রাক্ষসীর গল্প শুনবো।’
_বাবা বলল; ‘রাক্ষসীর গল্প শুনলে কি আর ক্ষুধা মিটবে? চিন্তা করোনা, ভাত আর ডিম ভাজিটা করে ফেলি। এটা তেমন কঠিন কাজ না।’
বাবা ভাত রান্না করতে গিয়ে দেখল, কাজটা যত সহজ ভেবেছিল, আসলে ততটা সহজ না। কতটুকু পানি দিতে হবে বাবা সেটা বুঝতে পারল না। পাতিলে পানি একবার বাড়িয়ে দেয় আবার কমিয়ে ফেলে। এভাবে কয়েকবার চেষ্টা করল, কিন্তু সফল হলো না। একবার ভাবল আম্মুকে ফোন দিয়ে পানির পরিমাণটা জেনে নেবে। কিন্তু পর মুহুর্তেই বাবাকে এই ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসতে হল। কারন আম্মু যে অভিমান করেছে, একবার কেন হাজার বার ফোন দিলেও মনে হয় না ভুল করে ফোনটা রিসিভ করবে। বাবা গ্যাসের চুলার একটায় ভাত আর অন্যটায় ডিম ভাজার জন্য কড়াই বসিয়েছে। আমি বাবার সাথে রান্না ঘরেই বসে আছি। এত কষ্টের মাঝেও কেন যেন আমার মনটা আনন্দে নেচে উঠল। আমার বাবা একজন মহা ক্ষমতাবান মানুষ। সব কাজ’ই সে করতে পারে। আম্মু কেন যে বাবাকে বলল; ‘তুমি হচ্ছো অকর্মার ঢেঁকি, তোমাকে দিয়ে কোন কিছুই হবে না।’
_বাবা বলল; ‘কিরে বাবা! মায়ের জন্য মন খারাপ লাগছে?’
আমি হ্যাঁ বা না কিছুই বললাম না।
_বাবা বলল; ‘তোমাকে এখন একটা গল্প শোনাব। কি গল্প শুনতে চাও বলো?’ আমি বললাম; ‘এখন না, খাবার খেয়ে তোমার কোলে শুয়ে শুয়ে গল্প শুনবো।’
ভাত আর ডিম ভাজি আমি খুব মজা করে খেলাম। ভাতটা একটু নরম হয়েছে, কিন্তু ডিম ভাজিটা হয়েছে চমৎকার। এতদিন আম্মু আমাকে খাইয়ে দিত। আজই প্রথম নিজের হাতে ভাত খেলাম। নিজের হাতে বাবার রান্না করা খাবার! কি যে আনন্দ লাগছে। আনন্দে গদগদ করে বলেই ফেললাম, ‘ধন্যবাদ বাবা!’
খাওয়া শেষ করে থালা-বাসন গুছিয়ে রেখে এসে বাবা দেখল, আমি ঘুমিয়ে পড়েছি। হাতটাও ঠিক মতো ধুতে পারিনি। হাতে ভাত লেগে আছে। বাবা আমার হাত ধুয়ে বিছানায় শুইয়ে দিল। আম্মুকে ছাড়া এটাই আমার জীবনের প্রথম ঘুম।
আনুমানিক রাত ১২টার দিকে বাবা আমাকে জোর করে ঘুম থেকে উঠাল। আমার মোটেও উঠার ইচ্ছে ছিল না। তবুও জোর করেই উঠিয়ে আমার শরীরের গেঞ্জি খুলে শার্ট পরিয়ে কোলে নিয়ে গাড়িতে বসাল। আমি বুঝতে পারলাম না, এই মধ্যরাতে আমরা কোথায় যাচ্ছি? আমার চোখে প্রচুর ঘুম। কিন্তু বাবার চোখে পানি দেখে মুহূর্তেই আমার ঘুম উধাও হয়ে গেল। চেয়ে দেখি বাবার দু’চোখ দিয়ে অনবরত অশ্রু ঝরছে। আমি বাবাকে কয়েকবার জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি কাঁদছো কেন? আমরা এত রাতে কোথায় যাচ্ছি?’ কিন্তু বাবা আমার কথার কোন উওর দিল না। শুধু দুই হাতে আমাকে বুকের সাথে জড়িয়ে রাখল।
কিছুক্ষন পর ড্রাইভার ঢাকা মেডিকেলের সামনে এসে গাড়ি থামালো। বাবা গাড়ী থেকে নেমে আমার হাত ধরে ভিতরে নিয়ে গেল। সেখানে কিছু পুলিশ বসে গল্প-গুজব করছিল। বাবা এক পুলিশকে কি যেন বলল। পরে সেই পুলিশ আমাদের আবছা অন্ধকার একটা রুমে নিয়ে গেল। সেখানে আরও কিছু লোক ছিল। আমরা যাওয়ার সাথে সাথে এক ডক্টর সাহেব একটা চাদর উঁচু করল। এরপর আমার আর কিছু মনে নেই।
ঘন্টা দু’ পর আমার যখন জ্ঞান ফিরল, তখন দেখি আমি আমার নানুর কোলে শুয়ে আছি। আমার সামনেই দুটো লাশ। একটা আমার আম্মুর! আমার কল্পনার রাক্ষসী। বাবার সাথে ঝগড়া করে নানু বাড়ি যাওয়ার পথে গাড়ি এক্সিডেন্টে মারা গেছে। আর দ্বিতীয়টি আমার বাবার! আমার রাজকুমার। যিনি আম্মুর লাশ দেখে হার্ট অ্যাটাক করে মারা গেছেন। আমি আম্মুকে জড়িয়ে ধরে অনেক ডাকলাম। অনেক..! বাবাকে রাক্ষসী আর রাজকুমারের গল্প শুনাতে বললাম। কিন্তু তাঁরা একটি বারের জন্যও চোখ খুলে আমায় দেখলোনা। আমার আর্তচিৎকারে সাড়া দিলো না…।