ছফওয়ান আল মুসাইব

অতিরিক্ত গুরুত্ব

অতিরিক্ত গুরুত্ব

এই পৃথিবীতে সম্পর্কের জটিলতা ঠিক যেনো এক সূক্ষ্ম সুতার মতো—একটু বেশি টান দিলেই ছিঁড়ে যায়, আবার ঢিলে রাখলে হারিয়ে যায়। আর এই টানাপোড়েনের কেন্দ্রে রয়েছে একটি শব্দ—“গুরুত্ব”। আমরা প্রতিনিয়ত কাউকে ভালোবেসে, গুরুত্ব দিয়ে তার হৃদয়ে জায়গা করে নিতে চাই। কিন্তু, কখনো কি ভেবে দেখেছি—আমরা যাকে এতটা গুরুত্ব দিচ্ছি, সে আদৌ কি এই গুরুত্বের যোগ্য?

অতিরিক্ত গুরুত্ব— নীরব আত্মঘাতঃ

আমরা অনেক সময়ই কারো প্রতি এমন ভাবে ভালোবাসা কিংবা গুরুত্ব প্রকাশ করি, যা তার যোগ্যতার চেয়েও অনেক বেশি। আমরা ভেবে নেই, অতিরিক্ত আন্তরিকতা হয়তো সম্পর্ককে আরও গভীর করবে, আমাদের অনুভূতি তাকে ছুঁয়ে যাবে। কিন্তু বাস্তবতা ঠিক এর উল্টো—অতিরিক্ত গুরুত্ব কখনো একজন মানুষকে কৃতজ্ঞ করে না, বরং তাকে করে তোলে আত্মকেন্দ্রিক ও অহংকারী।

যখন আপনি কাউকে তার প্রাপ্যের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেন, তখন আপনি অজান্তেই তাকে এমন এক অবস্থানে বসিয়ে দেন, যেখানে সে ধরে নেয়—”আপনি তো সবসময়ই থাকবেন, তার পাশে থাকাই আপনার দায়িত্ব।” এখান থেকেই শুরু হয় অবহেলার সূক্ষ্ম যন্ত্রণা। মানুষ সহজে পাওয়া জিনিসের মূল্য দিতে জানে না, বরং হেলাফেলা করতে শিখে যায়।

একজন মানুষ যখন আপনাকে হাঁটু পর্যন্ত গুরুত্ব দেয়, আর আপনি তার জন্য কোমর পর্যন্ত নেমে যান, তখন সেটি আর আত্মত্যাগ নয়—তা হয় আত্মবিসর্জন। আপনি চেয়েছিলেন সে আপনাকে বুঝুক, অনুভব করুক আপনার নিঃস্বার্থ ভালোবাসা। অথচ সে তা বোঝার আগ্রহই হারিয়ে ফেলে, কারণ আপনার সবটা পেয়ে সে আর কিছু পাওয়ার প্রয়োজনই অনুভব করে না।

মানুষের স্বভাবই এমন—যা অবাধে পায়, তা ধরে রাখতে শেখে না। আপনি তাকে যতটা সহজ করে নিজের জীবনে ঢুকতে দেন, সে ততটাই সহজে আপনাকে গুরুত্বহীন করে ফেলে। আপনি যে সম্মানের আসনে তাকে বসিয়েছিলেন, সে আসনের উঁচুতে দাঁড়িয়ে আপনাকেই ছোট করে দেখে।

নিজের মূল্যবোধ গড়ে তুলুনঃ

এই সমাজে টিকে থাকতে হলে কেবল আবেগ দিয়ে নয়—চলতে হয় নিজস্ব ব্যক্তিত্বআত্মমর্যাদার উপর দাঁড়িয়ে। সম্পর্ক নিঃসন্দেহে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ, কিন্তু সম্পর্কের টানে নিজের আত্মসম্মান বিসর্জন দেওয়া কখনোই বুদ্ধিমানের কাজ নয়।

যে মানুষটি সত্যিকার অর্থে আপনাকে ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে—তার কাছে আপনাকে নিজের মূল্য প্রমাণ করতে হয় না। সে নিজ থেকেই আপনার গুরুত্ব বোঝে, আপনার অনুভূতিকে সম্মান করে। কিন্তু যে ব্যক্তি আপনার মূল্য বোঝে না, তার প্রতি অতিরিক্ত সম্মান দেখিয়ে নিজের আত্মমর্যাদাকে ক্ষুণ্ন করা এক প্রকার আত্মপ্রবঞ্চনা ছাড়া আর কিছুই নয়।

অনেক সময় আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় কষ্টগুলোর উৎস হয় অযথা কাউকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দেওয়া। আমরা ভাবি, ‘সে বুঝবে’, ‘সে একদিন মূল্য দেবে’। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমরা শুধু নিজের গুরুত্বটাই হারিয়ে ফেলি।

যার প্রাপ্য যতটুকু, তাকে ততটুকুই দিন।
মূল্য ও গুরুত্বের ভারসাম্য বজায় রাখুন।

অন্যথায় আপনি নিজেই নিজের ব্যক্তি-মানসিকতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবেন, নিজের আত্মবিশ্বাসকে ক্ষীণ করে তুলবেন।

এটা মনে রাখতে হবে—আত্মসম্মানই মানুষের সবচেয়ে বড় সম্পদ। এটি এমন একটি মশাল, যা একবার নিভে গেলে তা পুনরায় জ্বালানো কঠিন। টাকা-পয়সা, গাড়ি-বাড়ি হারালেও সময়ের সঙ্গে তা ফেরত পাওয়া যায়। কিন্তু আত্মমর্যাদা বা ব্যক্তিত্ব একবার হারিয়ে গেলে তা আর সহজে ফিরে আসে না।
এটি গড়ে ওঠে আত্মচর্চা, অভিজ্ঞতা ও নিজের মূল্যবোধকে আঁকড়ে ধরে রাখার মাধ্যমে। আর এই মূল্যবোধের সুরক্ষার জন্যই মাঝে মাঝে সম্পর্ক থেকেও নিজেকে গুটিয়ে নিতে হয়।

নিজেকে হারিয়ে কাউকে ধরে রাখার চেয়ে, নিজেকে বজায় রেখে কাউকে হারিয়ে ফেলা অনেক বেশি গৌরবের।

ব্যালান্সের নামই পরিণত সম্পর্কঃ

একটি সম্পর্কের সৌন্দর্য তখনই ফুটে ওঠে, যখন দুজন মানুষ একে অপরকে সমানভাবে মূল্য দেয়। যদি কোনো এক পক্ষ সব দেয় আর অন্য পক্ষ শুধু নেয়, তাহলে সেই সম্পর্ক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। তখনই দেখা যায়, একপক্ষ ভালোবাসায় ডুবে যাচ্ছে, আর অন্যপক্ষ অবহেলার পাহাড় গড়ে তুলছে।

আপনি যদি তাকে ষোল আনার গুরুত্ব দেন, অথচ সে আপনার জন্য এক আনার চেষ্টাও না করে—তাহলে বুঝে নিতে হবে, আপনি ভুল বিনিয়োগ করছেন। সম্পর্ক হোক বা বন্ধুত্ব, মূল্যবোধ ও পারস্পরিক সম্মান ছাড়া তা টিকতে পারে না।

নিজেকে ভালোবাসুন, নিজের গুরুত্ব বুঝুনঃ

নিজেকে গুরুত্ব দিতে শিখুন। কারণ আপনি যদি নিজেকে অবহেলা করেন, তাহলে কেউ আপনাকে গুরুত্ব দেবে না। আপনার চোখের জল, আপনার হাসি, আপনার ভালোবাসা—এই তিনটি জিনিসেরই মূল্য অনেক। আপনি যখন বুঝে যাবেন কোন মানুষটার জন্য সত্যিই কাঁদা উচিত আর কার জন্য নয়, তখন আপনি শুধু চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া জল মুছবেন না, বরং তার কারণটাকেও জীবনের পৃষ্ঠা থেকে মুছে ফেলতে শিখে যাবেন। যখন আপনি মুখের হাসির মূল্য বুঝে যাবেন, তখন আপনি দুঃখের মাঝেও হাসতে শিখবেন—শুধু বাহ্যিক নয়, ভেতর থেকে। 

শেষ কথা:

প্রত্যেক সম্পর্কেই কিছুটা বোঝাপড়া, কিছুটা ছাড় দেওয়া থাকে—কিন্তু নিজের আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে নয়। কাউকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দিয়ে যদি আপনাকে নিজেকে তুচ্ছ মনে হয়, তবে সে গুরুত্ব কখনোই প্রয়োজনীয় ছিল না।

“নিজেকে ভালোবাসতে শিখুন। নিজেকে সম্মান করুন। যে আপনাকে ততটুকু মূল্য দেয়, তাকেই ততটুকু গুরুত্ব দিন। নিজের ব্যক্তিত্বকে বিসর্জন দিয়ে কাউকে সন্তুষ্ট করার প্রয়োজন নেই।”

জীবন ছোট, অথচ মূল্যবান। এই স্বল্প সময়ে এমন মানুষের পাশে থাকুন, যারা আপনাকে সত্যিকার অর্থেই মূল্য দেয়। মনে রাখবেন—আপনার আত্মসম্মানই আপনার আসল পরিচয়।

 

আমার সম্পর্কে

আমি ছফওয়ান আল মুসাইব, একজন 3D আর্টিস্ট, ভিডিও এডিটর। 3D আর্টের প্রতি গভীর ভালোবাসা থেকেই আমি আমার ক্যারিয়ার শুরু করি, এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজের দক্ষতা গড়ে তুলেছি। পেশাগত জীবনে সাফল্যের পাশাপাশি আমি গল্প লেখা এবং ভ্রমণে দারুণ আগ্রহী। শখের বসে মাঝে মাঝে হাতে কলম তুলে নিই এবং আমার মনের ভাবনা ও অনুভূতিগুলোকে শব্দে রূপ দিই। আমার লেখা গল্পগুলো বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছে, যা অনেক পাঠকের হৃদয় ছুঁয়ে গেছে।

জনপ্রিয় পোস্ট

সাম্প্রতিক পোস্ট